শক্তিশালী বোমা আইইডি

নব্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আবদুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছির (২২)। সংগঠনটির কোনো বৈঠকে অংশ না নিয়ে বা কোনো সদস্যের সঙ্গে বাহ্যিক যোগাযোগ না রেখেই শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার নির্দেশে কাজ করে যাচ্ছিলেন।

দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া বাছির শুধুমাত্র ভিডিও দেখে তৈরি করেন শক্তিশালী রিমোট কন্ট্রোলড ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)। শক্তিশালী বোমাটি তৈরিতে বাছির খরচ করেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। নব্য জেএমবির আমির ও একজন সুরা সদস্যের নির্দেশে বোমা তৈরি, হামলার স্থল নিজেই রেকি করে পরিকল্পনা সাজান।

হামলার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৪ জুলাই রাতে পুরানা পল্টন পুলিশ চেকপোস্টের পাশে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটান তিনি। পুলিশ চেকপোস্ট থেকে একটু দূরে নির্জন স্থানে বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ায় কেউ হতাহত হননি।

এ ঘটনার পর থেকেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) খুঁজছিল বাছিরকে।  কর্মস্থলের সূত্র ধরে রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসির বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও সিটিআই-২।

গ্রেফতারের পর বাছিরকে জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর সব তথ্য পায় সিটিটিসি। তিনি কোনো  যোগাযোগ ছাড়া সংগঠনের আমিরের মৌখিক অথবা দূর-নির্দেশনার মাধ্যমে বোমা বানানো থেকে বিস্ফোরণ পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকেন।

যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়ান বাছির

সিটিটিসি বলছে, বাছির ২০১৭ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্রবাদী নানা ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান। নব্য জেএমবির সঙ্গে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত নানা কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াতে থাকেন। এসব কর্মকাণ্ড সিটিটিসির নজরে এলে ২০১৮ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের পর তাকে আদালতের নির্দেশে গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর তিন মাস থাকার পর জামিনে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বের হম জামিনে। সেখানে থাকাকালীন নব্য জেএমবির আরও অনেক সদস্যের সঙ্গে দেখা হয় বাছিরের।  তাদের সঙ্গে থেকে তিনি উগ্রবাদী মতাদর্শে আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এছাড়া তাদের মাধ্যমে নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয় তার।

আমিরের নির্দেশে হামলার পরিকল্পনা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, জেএমবির আমির মাহাদী হাসান তুরস্কে রয়েছেন। কারাগার থেকে বের হয়ে বাছির জেলে থাকা জঙ্গিদের সাহায্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন আমিরের সঙ্গে। হামলার আগে ও পরে বাছির নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমিরের সঙ্গে কথা বলতেন।

আমিরের নির্দেশে এবং জেএমবির সুরা সদস্য আবু মোহাম্মদের সাহায্যে হামলার পরিকল্পনা করেন বাছির।  আবু মোহাম্মদের সঙ্গে তার কোনো বাহ্যিক যোগাযোগ ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই কথা হতো।

নব্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আবদুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবু বাছির

এ বিষয়ে সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাছির মূলত একজন রিমোট কন্ট্রোলড জিহাদি। বিদেশে বসে তাকে কেউ একজন নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সে অনুযায়ী বাছির হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আইইডি বানানো শেখা, সরঞ্জাম সংগ্রহ ও সর্বশেষ হামলা পর্যন্ত করেছেন। হামলার পর থেকেই তাকে আমরা খুঁজছিলাম। সর্বশেষ কর্মস্থলের সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।  

যেভাবে বোমা বানাতে শেখেন

সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি আমির যখন পুলিশের ওপর বোমা হামলা করার নির্দেশ দেন, তখন বাছির জানতে চান বোমা কীভাবে পাবেন। তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী বাছিরকে টেলিগ্রাম অ্যাপে বোমা বানানোর একটি ভিডিও এবং বিকাশে পাঁচ হাজার টাকা দেন আবু মোহাম্মদ।

রিমোট কন্ট্রোলড আইইডি কীভাবে বানাতে হয়, সেই ভিডিও দেখে তা শেখেন বাছির। এর মধ্যে কোথা থেকে আইইডি বানানোর সরঞ্জাম পাওয়া যাবে, সেই তথ্য তুরস্কে বসে বাছিরকে দেন জেএমবি আমির। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে  বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন বাছির। এরপর ভিডিও দেখে চার থেকে পাঁচ দিন সময় নিয়ে বোমাটি তৈরি করলেও কিছু ত্রুটি থেকে যায়। পরে আবু মোহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে বাছিরকে প্রশিক্ষণ দেন। এরপর বোমাটি তৈরির কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।  

নজরদারি এড়াতে হামলার আগে বাসা পরিবর্তন করেন

সিটিটিসি জানায়, জেল থেকে জামিন বের হয়ে বাছির রাজধানীর তোপখানা রোডের একটি বাসায় ওঠেন। এ বাসায় থাকা পর্যন্ত সিটিটিসির নজরদারিতে ছিলেন তিনি। পরে নজরদারি এড়াতে এবং নির্জনে গোপনীয়ভাবে বোমা বানাতে  আমিরের নির্দেশে রাজধানীর মান্ডায় এলাকায় একটি বাসায় একা ওঠেন। সেই বাসা থেকেই হামলার পরিকল্পনা এবং আইইডি তৈরি করেন বাছির। হামলার দিন সেই বাসা থেকেই ঘটনাস্থলে আইইডি নিয়ে আসেন তিনি।

যে কারণে পল্টন পুলিশ চেকপোস্টকে বেছে নেন বাছির

এ বিষয়ে ডিএমপি সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জেমবি আমির সুবিধাজনক স্থানে পুলিশের ওপর আইইডি দিয়ে হামলা করতে বাছিরকে নির্দেশ দেন।  সে নির্দেশনা অনুযায়ী বাছির বোমা রাখার জন্য একটি নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকেন, যেখানে সিসি ক্যামেরা নেই।  

পল্টনের পুলিশ চেকপোস্টে একাধিকবার রেকি করেন বাছির। আশপাশে তিনি ভালো করে রেকি করে দেখতে পান কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। রাজধানীতে একাধিক পুলিশ বক্সের হামলার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও পল্টনের ঘটনার ক্ষেত্রে নেই। পরে তিনি সুবিধাজনক স্থান হিসেবে গত বছরের ২৪ জুলাই রাতে পুরানা পল্টনের পুলিশ চেকপোস্টে বোমাটি রাখেন।  রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটান।  আমরা তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব।

এমএসি/আরএইচ