রাজধানীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সমস্যার পরিধি। এর সঙ্গে নিত্যদিনের সঙ্গী শহরের দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বাসাবাড়ির ময়লাসহ রাজধানীতে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। এসব বর্জ্য অপসারণে হিমশিম খেতে হয় দুই সিটি করপোরেশনকে। 

যদিও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমে গতি ফেরাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়াসহ সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থা দুটি। তবুও আছে নানা অভিযোগ, বর্জ্য অপসারণে অব্যবস্থাপনা গোটা নগরবাসীর মুখে মুখে! এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিয়ে নাগরিকসেবা নিশ্চিত করার দাবি সবার। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ২৪০০ থেকে ২৭০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। মৌসুমি ফলের সময় এর পরিমাণ বেড়ে যায়। এখন প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। 

কিন্তু মেগাসিটি ঢাকায় এখনো আধুনিক, টেকসই ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে সংস্থা দুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে ডিএনসিসির উদ্যোগ 

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, খোলা জায়গায় বর্জ্য রেখে তা অপসারণের যে ব্যবস্থা ছিল তা রহিত করা হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ৫৭টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করা হয়েছে। গত এক বছরে পাঁচটি এসটিএস নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে দুটি নির্মাণাধীন। 

ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, আগে খোলা অবস্থায়, খোলা ট্রাকের মাধ্যমে বর্জ্য পরিবহন করা হতো। এখন তা বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত আছে ২৪টি কম্প্যাক্টর, ৩৪টি কন্টেইনার ক্যারিয়ার ও ১৭টি ডাম্প ট্রাক। এগুলোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে। আরও ১১টি পরিবেশবান্ধব কম্প্যাক্টর ও দুটি ব্যাকহো লোডার কেনার ব্যবস্থা হয়েছে। ইতোমধ্যে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। 

এছাড়া বদ্ধ ড্রেন আধুনিক পদ্ধতিতে পরিষ্কারের জন্য দুটি মেকানিক্যাল জেট অ্যান্ড সাকার কেনা হয়েছে। যান্ত্রিকভাবে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য নয়টি অত্যাধুনিক রোড সুইপার আছে ডিএনসিসির। নতুন তিনটি রোড সুইপার কেনা প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া বায়ুদূষণ রোধে দুটি ওয়াটার স্প্রে ক্যানন কেনা হয়েছে। 

ডিএনসিসি সূত্রে আরও জানা যায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানে উন্নীত করতে জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় জাইকা কর্তৃক ‘ক্লিন ঢাকা মাস্টার প্ল্যান ২০২০-৩৫’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এর খসড়া প্রস্তুত করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে। 

গত অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডের ৮৪ শতাংশ বর্জ্য অর্থাৎ প্রায় ১১ লাখ টন গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন করে আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে পরিবেশসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে। 

৩০টি কম্প্যাক্টর কিনছে ডিএসসিসি 

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। এখন পর্যন্ত ৪২টি অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে ৭৫টি ওয়ার্ডেই বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এছাড়া সব ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের নিবন্ধন শেষ হয়েছে। 

ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য সংগ্রহকারীদের নামও নিবন্ধন করেছি। তারা সরাসরি বাসাবাড়ি ও স্থাপনা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবেন। এছাড়া আমরা আধুনিক সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করছি। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ১৫টি ১০ টন ও ১৫টি সাত টন ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৩০টি কম্প্যাক্টর ভেহিকল কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। 

তিনি বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ওয়ার্ডভিত্তিক অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে নগরবাসীকে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উপহার দেওয়া হবে। 

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের উদ্বোধন শেষে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ২০২২ সালের পর ঢাকা শহরের যত্রতত্র ও উন্মুক্ত স্থানে আর বর্জ্য থাকবে না। আমরা ওয়ার্ডভিত্তিক একটি করে অন্তবর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আমাদের ৭৫টি ওয়ার্ডেই এ কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ওয়ার্ডে এটি চলমান আছে। 

উত্তরের খাল থেকে ৭৫ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে খালগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৭৫ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাসার মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে খালগুলো থেকে প্রায় ৬৫ হাজার টন ভাসমান বর্জ্য এবং নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য আরও প্রায় ১০ হাজার টন স্লাজ (কর্দম) অপসারণ করা হয়েছে। এখন এসব খালের পানিপ্রবাহ সচল রয়েছে। 

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসার অধীন ২৯টি খাল ডিএনসিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে ডিএনসিসির উদ্যোগে খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি খালের দুই পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করে তা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

তবুও অব্যবস্থাপনা 

আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দুই সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এরপরও রয়েছে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। বর্জ্য নিয়ে বাণিজ্য, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, খোলা গাড়িতে বর্জ্য পরিবহন— ঢাকা শহরকে যেন আরও বেশি অপরিচ্ছন্ন ও বসবাস অনুপযোগী করে তুলছে। 

রাজধানীর মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা কার্তিক দাস বলেন, অনেক সময় বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রের বাইরে ময়লা স্তূপ করে রাখা হয়। উৎকট গন্ধে পথচারীসহ স্থানীয়দের এ সময় পথচলা হয়ে পড়ে দায়। এছাড়া খোলা ট্রাকে করে ময়লা স্থানান্তর করা হয়। ফলে রাস্তাজুড়ে দুর্গন্ধ এবং বিভিন্ন স্থানে ময়লা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে আরও বেশি তৎপর হওয়া উচিত— মনে করেন তিনি। 

রাজধানীর গুলশান লেকপাড় এলাকায় বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) নির্মাণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এখানে এটি নির্মাণ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে শহরের ভেতরে বা পাড়া-মহল্লায় এমন কেন্দ্র (এসটিএস) নির্মাণ করা উচিত হয়নি। একদিকে দুর্গন্ধ অন্যদিকে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ময়লা লোড করে যখন বড় বড় গাড়ি এলাকা থেকে বের হয় তখন এসটিএসের সামনের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের মুখে রুমাল চেপে চলতে হয়। 

মোখলেছুর রহমানের অভিযোগ, এলাকাভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে মাস শেষে প্রতিটি বাসাবাড়ি থেকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের উচিত একটি রেট নির্ধারণ করে দেওয়া। তার মন্তব্য, ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেমন সিটি করপোরেশনের নজর দেওয়া উচিত, তেমনি এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয় যাতে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহোতে হয়।’ 

এএসএস/এমএআর//