প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে মন্ত্রী, আমলা, চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৫ শতাধিক ব্যক্তি টিকা নিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রথম দিনে টিকাদান কর্মসূচির সফল উদ্বোধনের পর দ্বিতীয় দিনেও সফলভাবে টিকাদানের সমাপ্তি হয়েছে। রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে দ্বিতীয় দিনে মোট ৫৪১ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

তার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২০ জনকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮ জনকে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০০ জনকে, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৫৮ জনকে এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৫ জনকে টিকাদান করা হয়েছে।

বিএসএমএমইউতে টিকা নিলেন ১৯৮ জন
সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া প্রথমে টিকা নিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এরপরে পর্যায়ক্রমে পরিচালক (হাসপাতাল) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. জুলফিকার আহমেদ আমিন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমানসহ হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা টিকা নেন।

বেলা ১১টায় টিকা নিতে আসেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী (আইসিটি) জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে প্রথম করোনার টিকা নিয়েছেন। টিকা নেওয়া শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি আপনাদের সামনেই টিকা নিয়েছি। কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। গতকাল আমাদের যারা টিকা নিয়েছে, তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একধরনের গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পলক বলেন, টিকা সম্পর্কে প্রথমে যে ধরনের মিথ্যা, গুজব এবং ষড়যন্ত্র চলছিল, সেগুলো মিডিয়ার কল্যাণে আমরা অনেকটাই প্রতিরোধ করতে পেরেছি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পেরেছি।

এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টিকা নেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান। টিকা নেওয়া শেষে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সরকারের প্রতি মানুষের ভরসা, আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ যেন আরও বাড়ে এজন্যই টিকা নেওয়া। টিকার ওপর মানুষের ভরসা বাড়াতেই সবার সামনে টিকা নিয়েছি।

তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার পর কোনোরকম অস্বাভাবিকতা বোধ করছি না। টিকা নিয়ে আমার মনে হচ্ছে, আগে যা ছিলাম এখনও তাই আছি।

ঢামেকে টিকা নিলেন ১২০ জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ১০০ জন পুরুষ ও ২০ জন নারীকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এ হাসপাতালে করোনার টিকা নিয়েছেন। ঢামেক কর্তৃপক্ষ জানায়, টিকা নেওয়া সবাই ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী ও স্বাস্থ্যকর্মী।

সকাল পৌনে ১০টায় শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। 

হাসপাতালের পরিচালক জানান, টিকা দেওয়ার পর সবাইকে আধাঘণ্টা আমাদের পোস্ট ভ্যাকসিনেশন জোনে রাখা হয়েছে। এরপর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২০ জনের মধ্যে কেউ অসুস্থ বা কোনো অস্বস্তি বোধ করেনি। স্বাভাবিক ও উৎসবমুখর পরিবেশেই আমাদের টিকাদান কার্যক্রম শেষ হয়েছে।

এর আগে ঢামেক সূত্র জানায়, হাসপাতালের করোনা টিকাদান কেন্দ্রে ১৪০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনার টিকা নেবেন। তাদের মধ্যে ২০ জন চিকিৎসক, ২০ জন নার্স ও ১০০ জন হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী ও স্টাফ।

কুর্মিটোলা হাসপাতালে ১০০ জনকে টিকা প্রয়োগ
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দ্বিতীয় দিনের মতো করোনার টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। চিকিৎসক-নার্স, আনসার সদস্যসহ মোট ১০০ জন টিকা নিয়েছেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আশাবাদী আজ ১০০ জনকে ভ্যাকসিন দিয়েছি। প্রথমেই হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকদের টিকা দিয়েছি। এরপর হবে জাতীয় কর্মসূচি। সেই ফাইনাল তারিখ এখনও আমরা অর্ডার পাইনি।

তিনি বলেন, আমরা যে টিকা ব্যবহার করছি তা অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। তারপরও অনেকের নানা কারণে সামান্য ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যতদিন পর্যন্ত এই টিকাদান প্রক্রিয়া চলবে ততদিন আমাদের ডেডিকেটেড টিম সবসময় প্রস্তুত আছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি ডেডিকেটেড টিম তৈরি করা আছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ম্যানেজ করার জন্য। পাশাপাশি ২০টি বেডসহ একটি রুম প্রস্তুত করা আছে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত গতকাল থেকে এ পর্যন্ত আমাদের কাছে এমন কেউ আসেনি যিনি এসে বলবেন, আমার খারাপ লাগছে বা কোনো সমস্যা হচ্ছে।

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে টিকা নিলেন ৫৮ জন
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল করোনা মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সের আতঙ্কিত সাইরেন, আইসিইউর সংকেত, রোগীর আত্মচিৎকার ও মৃতের স্বজনদের কান্না আহাজারির শব্দেই দিন পার হতো ডাক্তার নার্সদের। তবে ব্যতিক্রম আজকের দিনটি। হাসপাতালটির প্রাঙ্গণে বইছে আনন্দ আর হাসির জোয়ার। কারণ, দেশে টিকা এসেছে।

বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকসহ বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কর্মীরা খুশি মনে নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা নিচ্ছেন।

টিকা নেওয়ার পর ফুল দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন তাদেরই সহকর্মীরা। করতালি দিয়ে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে একটি করে চকলেট। টিকা নেওয়ার পর চেহারায় কোনো দুশ্চিন্তা বা ভয় দেখা যায়নি। বরং খুশি দ্রুত এই মরণঘাতীর প্রতিষেধক নিতে পেরে।

কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব ভালো লাগছে সহকর্মীদের টিকা নেওয়া দেখে। তারা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন করোনার রোগীদের সামাল দিতে। এদের মধ্যে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। আজ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিষেধক হিসেবে টিকা দেওয়া হলো।

তিনি আরও বলেন, আজ মোট ৫০ জনকে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ৫৫ জন টিকা নিয়েছেন। টিকা নেওয়ার পর আমরা তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাকে দ্রুত চিকিৎসা সেবা দিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা প্রায় ১টা পর্যন্ত টিকা দেওয়ার কার্যক্রম চলেছে।

মুগদা মেডিকেলে টিকা নিলেন ৬৫ জন
এদিকে বেলা ১০টায় মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। শুরুর দিনে হাসপাতালটিতে করোনা টিকা নিয়েছেন ৬৫ জন চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী। এ হাসপাতালটিতে শুরুতেই টিকা নেন ডা. নন্দিতা পাল।

অনুভূতি জানাতে গিয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, করোনার সময় আমরা মানুষের বিভীষিকা দেখেছি। খুব কাছ থেকে তাদের চিকিৎসা দিয়েছি। তাই টিকা নেওয়ার আগে মনে হয়েছে, জীবন-মৃত্যর মধ্যে সেতুর এপার অথবা ওপার।

ডা. নন্দিতা পাল বলেন, টিকা নেওয়ার আগে মনে হয়েছে সেতুর এপার-ওপার। কিন্তু টিকা নেওয়ার পর সুস্থ বোধ করছি। আসলে এই টিকা তো পরীক্ষিত। সুতরাং ভয় পাওয়ার তেমন কিছু নেই। কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো থাকবেই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে চারটি বুথে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২০ জনকে দেওয়া হয়েছে। আজ মোট ৬০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। যারা টিকা নিয়েছেন তাদের প্রত্যককে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। আগামী ২৯ মার্চ টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার টিকাদানের পর আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিকাদান বন্ধ রাখা হবে। এই কয়েক দিন টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে।

টিকা কেন্দ্রে ঈদ উৎসব বিরাজ করছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকা কার্যক্রম উদ্বোধনের পর আজ রাজধানীর ৫টি হাসপাতালে আনন্দঘন পরিবেশে টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, প্রতিটি টিকা কেন্দ্রে ঈদ আনন্দ বিরাজ করছে। আপনারা আসুন, টিকা নিন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, টিকা নিয়ে আমরা দেশবাসী সবাই আনন্দিত। আজ টিকা কার্যক্রম অনুষ্ঠানে সকলের মধ্যে ঈদের মতো আনন্দ উৎসব বিরাজ করছে। ঈদ আনন্দে টিকা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজকে প্রতিটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই আনন্দঘন পরিবেশে টিকা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

টিআই/জেডএস