অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে রেলওয়ের মহাপরিচালক করার পাঁয়তারা
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে আছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের রোলমডেল হওয়ার যাত্রায় পিছু ছাড়ছে না দুর্নীতির কালো ছায়া। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘জিরো টলারেন্স’। চলছে অভিযান। তবু সম্প্রতি দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়েছে দুই ধাপ। এই যখন চিত্র, তখন চলছে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃতীয় গ্রেডের এক কর্মকর্তাকে রেলওয়ের মহাপরিচালক বানানোর পাঁয়তারা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই কর্মকর্তার নাম মোহাম্মদ হাসান মনসুর। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৫০টি রেলকোচ (ক্যারেজ) ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। ওই প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ে। তাই ‘শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গার’ আশঙ্কায় রেলওয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। দ্বিতীয় গ্রেডের তিন জন কর্মকর্তা থাকার পরও তৃতীয় গ্রেডের ওই কর্মকর্তা রেলওয়ের মহাপরিচালক হলে রেলের ‘ক্ষেত যে বেড়ায় খাবে’ তা নিয়েই শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বিজ্ঞাপন
• ১৫০টি রেলকোচ ক্রয় প্রকল্পে বিধি লঙ্ঘন করেন মনসুর
• তদন্ত হলেও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না
• তৎপরতা চালাচ্ছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা
• ‘শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গার’ আশঙ্কায় রেলওয়ের কর্মকর্তারা
বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে, রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ জানুয়ারি। ৩০ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাওয়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতির বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানান। অনেকে ধারণা থেকে বলে আসছিলেন মো. শামছুজ্জামান রেলের ডিজি পদে থাকার জন্য চেষ্টা করে আসছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি এই পদে থাকছেন না বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
তার অবসরে যাওয়ার পরই পদোন্নতির মাধ্যমে নতুন কাউকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। রেলওয়েতে দ্বিতীয় গ্রেডের কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার, মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) মিহির কান্তি গুহ ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী।
সূত্র জানায়, তাদের টপকে তৃতীয় গ্রেডের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরকে মহাপরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা। তিনি রেলে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের আস্কারা দিয়ে তাদেরকে নিয়েই চক্র গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’ একইভাবে অন্য দুজনও মন্তব্য করতে চাননি।
জানা গেছে, হাসান মনসুর অনেক আগে থেকেই প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ (ক্যারেজ) ক্রয় প্রকল্পে বিধি লঙ্ঘন করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এজন্য অভিযোগ তোলে। গত বছরের ২৪ জুন সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এজন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) প্রণব কুমার ঘোষকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য করা হয় একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আলী কবীরকে। কমিটি ক্রয় প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় বিধি বিধান না মানার জন্য প্রকল্প পরিচালককে দায়ী করে।
ক্রয় প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে সেটি প্রক্রিয়াকরণে ব্যত্যয় সৃষ্টিকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল তখন। ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে দাখিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ওই সভায়। জানা গেছে, তদন্ত হলেও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর নিজেই দোষ স্বীকার করেছেন। তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ কিনতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প অনুমোদন হয়। তারপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় গত বছরের ২৯ জুলাই। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ার সুংশিন আরএসটি-পসকো ইন্টারন্যাশনাল যৌথ কোম্পানি। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ও ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় এসব কোচ সংগ্রহের চুক্তি হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ইডিসিএফ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১৫০টি এমজি ক্যারেজ শীর্ষক প্রকল্পের কারিগরি দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ইডিসিএফ কোরিয়া বরাবর কনকারেন্সের জন্য পাঠানোর আগে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রকল্প পরিচালকের কাছে লিখিতভাবে কৈয়িফত তলব করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর মনসুর কৈফিয়তের জবাব বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে পাঠান।
তিনি জবাবপত্রে জানান, এর আগে ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভের টেকনিক্যাল বিড ইভ্যুলেশন রিপোর্ট কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়নি। তখন প্রকল্প পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরী এক্ষেত্রে সংস্থা প্রধানের অনুমোদন গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরীকে অনুসরণ করেছেন জানিয়ে মনসুর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ হাসান মনসুর বলেন, ‘আমি কোনো বিষয়ে মন্তব্য করব না।’ আর বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মৃতপ্রায় রেলওয়েকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। কম খরচে, নিরাপদে যাতায়াতের জন্য নতুন রেলপথ নির্মাণ করছে সরকার। এ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে দেশে ৭৯টি রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। চলছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ। গত ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব বড় অবকাঠামো উন্নয়ন যখন তড়িৎ গতিতে চলছে, তখনই রেলকোচ ক্রয় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর শম্বুকগতি আনেন বলে অভিযোগ।
পিএসডি/এইচকে