কিছু রোহিঙ্গা নিতে রাজি মিয়ানমার : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্য থেকে মিয়ানমার কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) আন্তর্জাতিক মডেল জাতিসংঘ সম্মেলন-২০২০ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ্য জানান।
বিজ্ঞাপন
আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারের কাছ থেকে কিছু পজিটিভ রেসপন্স পাওয়া গেছে। তারা কিছু রোহিঙ্গা নেবে। মিয়ানমার ক’জন নেবে সেটার একটা তালিকা দিয়েছে। আমরা বলেছি, তোমরা নেওয়া শুরু কর।’
তবে মিয়ানমারের পাঠানো তালিকা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি মন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
‘আমরা এখন ঐকমত্যে পৌঁছেছি। তারা একটা সংখ্যা দিয়েছে। এটাতো একদিনে যাবে না। নেওয়ার প্রসেসটা শুরু হবে। মোটামুটি আমরা চাই প্রত্যাবাসনটা শুরু হোক।’
ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হওয়া ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে মোমেন বলেন, ‘পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে মিটিং হয় সেখানে আমরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। তারা মোটামুটিভাবে সবগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছে গেছে।’
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, তারা কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নেবে। আমরা তাদের ইতোমধ্যেই ৮ লাখেরও বেশি একটা তালিকা দিয়েছি। তারা মাত্র ৪২ হাজার ভেরিফাই করেছে। আর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ডিজি লেভেলের বৈঠক হবে। সেখানে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। আমরা চাই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হোক।
এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিন্ট থোয়েকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমি চিঠিতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাও। তাদের কারণে সবার উন্নয় ব্যহত হচ্ছে। আমি বলেছি, শান্তিপূর্ণ সমাধানে সবারই মঙ্গল।’
তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ জানুয়ারি আব্দুল মোমেনকে লেখা চিঠিতে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়কমন্ত্রী কাইয়া টিন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা জানান। এজন্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসরণ করতে চায় বলে জানায় মিয়ানমারের মন্ত্রী।
মোমেন বলেন, ‘আমরা সর্বোমোট আট লাখ ৩০ হাজারের মতো তালিকা দিয়েছি। তারা এরমধ্যে মাত্র ৪২ হাজারকে যাচাই-বাছাই করেছে। তবে এরমধ্যে আরও কিছু দিয়েছে।’
শুনতে পেয়েছি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের একটা দ্বন্দ্ব চলছে- বক্তব্যে যোগ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জাতিসংঘ মহাসচিবের পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গে মোমেন জানান, নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতিসংঘের সমাসচিবকে চিঠি দেই। আমি বলেছি, সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমার অঙ্গীকার করেছে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর মতো পরিবেশ তৈরি করবে, কিন্তু এখনও কিছু করে নাই।
মোমেন জানান, আমি বলেছি, জাতিসংঘ রাখেইনে তাদের কর্মতৎপরতা বাড়াবে বলে আমাদের অঙ্গীকার করেছে। সেই জিনিসটা বাড়ানো হলে আমরা খুশি হব। বিশেষ করে স্পেশাল প্রতিনিধি আছেন, তিনি যেন সেখানে গিয়ে তাদের তাগাদা দেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠির জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জানান, মিয়ানমারকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে চাপ দিচ্ছে সংস্থাটি।
ভাসানচর প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব চিঠিতে কিছু উল্লেখ করেননি বলে জানান মোমেন।
এ সময় জাতিসংঘের কিছু সংস্থার সমালোচনা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, জাতিসংঘের লোকেরা যারা এখানে কাজ করেন তারা আমাদের তাগাদা দেন রোহিঙ্গাদের জীবন মানের উন্নয়ন করার। আমরা তাদের বলি, তাদের যেখানে ভবিষ্যত সেখানে গিয়ে তাগাদা দেন। আমরা যা যা করার দরকার করেছি। আপনারা ওখানে গিয়ে কাজ করেন।
ভাসানচর নিয়ে জাতিসংঘের আপত্তির বিষয়ে মোমেন বলেন, ‘এটা অজ্ঞতার কারণে। কিছু কিছু মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এটা বাধা দিয়েছে। যার ফলে আমাদের অনেকদিন দেরি হয়েছে। নিয়ে যাওয়ার পর তাদের একটা ধারণা ছিল এটা ভেসে যাবে। এটা যে বহুআগে তৈরি হয়েছে, বহুলোক এখানে থাকছে। তারা ভালো আছে, তারা খুশি। আমরা কি করব আমাদের খুশি। তোমাদের কাজ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকে বাংলাদেশের পাশে ছিল জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ তাদের ভরণ-পোষণে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে সংস্থাটি। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে মনোমালিন্যও ছিল সংস্থাটির। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনও কয়েকবার প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন।
সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে সরকারের সঙ্গে বেশ দূরত্ব তৈরি হয় জাতিসংঘের। কারণ রোহিঙ্গাদের এখনই ভাসানচরে স্থানান্তরের পক্ষে ছিল না সংস্থাটি। তবে জাতিসংঘের মনোমালিন্য উপেক্ষা করে এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের চারটি দল ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে সরকার।
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এক লাখকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ করে সরকার। দ্বীপটিতে অনেক আগে থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা করছিল সরকার। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের চাপে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে টেকনাফ ও উখিয়ায় থাকা রোহিঙ্গার মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ জনকে প্রথম দফায় ভাসানচরে নেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ২৮ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৫ জন রোহিঙ্গা নোয়াখালীর ওই দ্বীপে গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে পৌঁছায়।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ও শনিবার তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭৭৮ জন ও ১ হাজার ৪৪৬ জনের রোহিঙ্গাদের দুটি দল নোয়াখালীর ভাসানচরে পৌঁছেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আগে থেকেই দেশে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিলেন।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।
এদিকে, রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে। সেখানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অঞ্চলভিত্তিক প্রত্যাবাসন চাইলেও মিয়ানমার ২০১৭ সালের করা চুক্তির পক্ষেই থাকে।
এনআই/এসএম