আকাশে ওড়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শেষে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে তারা ভর্তি হন ফ্লাইং স্কুলে। সব ধাপের পর যখন ক্লাস শুরুর সময় হয়, তখনই আসে দুঃসংবাদ। কোর্স বন্ধ ঘোষণা করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। এতে অনিশ্চয়তায় পড়ে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক বেসরকারি পাইলট প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের ১৬ শিক্ষার্থীর জীবন। 

শিক্ষার্থীরা জানান, বেশ কয়েকটি ধাপ পার হয়ে তারা ফ্লাইং স্কুলের ২০তম ব্যাচে ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিলে। তবে হঠাৎ প্রতিষ্ঠানটি তাদের জানিয়ে দিয়েছে, কোর্স চালু সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের আকস্মিক এমন সিদ্ধান্তে হতভম্ব শিক্ষার্থীরা।

তারা জানান, ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর নতুন ব্যাচের (ব্যাচ ২০) জন্য ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আরিরাং ফ্লাইং স্কুল। বিজ্ঞপ্তির ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে বাংলাদেশ বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিএটিসি) প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ২৪ জনকে বাছাই করে আরিরাং।

সব ধরনের যাচাই-বাছাই শেষে ১৬ জনকে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত করা হয়। এরপর চূড়ান্ত মনোনীত সেই ১৬ শিক্ষার্থীর মেডিকেল এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় বেবিচক সদর দফতরে। ভর্তির জন্য মনোনীতদের টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া ভর্তির অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে আরিরাং জানায়, ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা অন্য কোনো কোর্সে পড়াশোনা, চাকরি বা ব্যবসা করতে পারবে না। তিনটির কোনটি করলে তাদের টার্মিনেট করা হবে।

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে মনোনীত ১৬ জনকে নিয়ে আরিরাং কর্তৃপক্ষ তাদের উত্তরা অফিসে একটি অরিয়েন্টেশনের আয়োজন করে। সেখানে স্কুলের নিয়ম-কানুন, প্রশিক্ষণ চলাকালীন করণীয়, বৈমানিক পেশার দিক-নির্দেশনা এবং ভর্তির নির্দেশনা সম্পর্কে জানায়।

শিক্ষার্থীদের বেবিচকের সিকিউরিটি ফর্ম দিয়ে ভর্তি নিশ্চিতের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত ১০ লাখ টাকা কোথায় ও কীভাবে জমা দিতে হবে, ওরিয়েন্টশনে তাও বলে দেওয়া হয়। তবে ৩ মার্চ স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি ই-মেইল পাঠিয়ে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে টাকা জমা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলে।

ওই ই-মেইলে ঢাকা এয়ারপোর্টের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালে বেবিচকের হ্যাঙ্গামর স্থানান্তরের নির্দেশনাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে নতুন ব্যাচের ক্লাস ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে শুরু করা হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জুনে ক্লাস শুরুর সেই আশ্বাস সেপ্টেম্বরে এসে ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্তে গিয়ে ঠেকে।

২০তম ব্যাচের  এক শিক্ষার্থী জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনো বেবিচক থেকে অনুমতির না থাকা, কখনো হ্যাঙ্গামর স্থানান্তরে সময় বেশি লাগা, কখনো করোনা মহামারিকে কারণ দেখিয়ে বারবার ক্লাস শুরুর তারিখ পেছাতে থাকে।

ভর্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও সেপ্টেম্বর মাসে আরিরাং কোর্সের ক্লাস শুরু করতে পারবে না বলে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয়। এ ঘোষণায় ঝুলে গেল ১৬ শিক্ষার্থীর আকাশে ওড়ার স্বপ্ন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০তম ব্যাচের  আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আরিরাংয়ে কোর্স চলাকালীন অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চাকরি বা ব্যবসায় সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাই কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি কিংবা অন্য কোথাও ভর্তিও হয়নি। কিন্তু আরিরাং সেপ্টেম্বরে যখন কোর্স হবে না বলে জানাল, তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এত অপেক্ষার পর কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আবার নতুন করে আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু করতে হবে।

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে মনোনীত ১৬ জনকে নিয়ে আরিরাং কর্তৃপক্ষ তাদের উত্তরা অফিসে একটি অরিয়েন্টেশনের আয়োজন করে। সেখানে স্কুলের নিয়ম-কানুন, প্রশিক্ষণ চলাকালীন করণীয়, বৈমানিক পেশার দিক-নির্দেশনা এবং ভর্তির নির্দেশনা সম্পর্কে জানায়।

এর আগে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে আরিরাং তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে এর দুদিন পরই বেবিচক এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। সেই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষ নতুন ব্যাচের (ব্যাচ ২০) ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তবে এ বছরের সেপ্টেম্বরে নানা অজুহাতে প্রতিষ্ঠানটি ক্লাস বন্ধ বলে ঘোষণা দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরিরাং নতুন কোনো কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করলে বা ক্লাস করালে বেবিচকের কোনো আপত্তি নেই।

অভিভাবকরা বলছেন, আকাশে ওড়ার স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা আবেদন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাবদ ৫০ হাজার টাকা খরচ করেন। ক্লাস করতে না পারায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। দুশ্চিন্তায় থাকা এ শিক্ষার্থীদের নিয়ে অবিলম্বে ক্লাস চালুর জন্য আরিরাংয়ের কাছে অনুরোধ জানান তারা।

এ নিয়ে জানতে চাইলে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের ট্রেনিং অ্যান্ড সিজিআই প্রধান আনিসুজ্জামান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে কোনো ধরনের গ্রাউন্ড ক্লাস হচ্ছে না। ক্লাস বন্ধের চূড়ান্ত বা স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। এখন ফ্লাইং ক্লাসগুলো হচ্ছে। যারা পুরনো ছাত্র, তারা ফ্লাই করছে। নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

আরিরাং এভিয়েশন স্কুলের কোর্স কোঅর্ডিনেটর মিজানুর রহমান বলেন, এ বছর আমাদের ক্লাস হচ্ছে না। আমরা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। কেন হচ্ছে না বা কী, তা আমাদের জানা নেই। পরে আবার কবে হবে, আদৌ হবে কি না, তাও আমাদের জানা নেই। ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের ওপর এসব নির্ভর করছে। তবে আপাতত নতুন কোনো ভর্তিও হবে না।

এআর/আরএইচ/এসকেডি