মিয়ানমারে কখনোই গণতন্ত্রের জন্য ভালো পরিবেশ ছিল না
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের অভিমত
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে, কিছুদিন ধরেই দেশটিতে এমন উদ্বেগ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। দেশটির ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চিসহ দলটির অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণাও এসেছে। এতে করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ এখন সেনাবাহিনীর হাতে।
বিশ্ব গণমাধ্যমে উঠে আসা তথ্যমতে, বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হওয়ার এক দশক পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রায় ৫০ বছরের অত্যাচারী সামরিক শাসনের অবসানের পর ২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরুর আগে সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থান দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের যে অবস্থা ছিল, সেটা তো সীমিত গণতন্ত্র। সরাসরি না করেও সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ভোগ করছিল।
ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি
মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সামরিক অভ্যুত্থান, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ দেশটির পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিতে পারে এসব বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্ট-এর নিজস্ব প্রতিবেদক নজরুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন সু চিকে সঙ্গে রেখে দেশ পরিচালনা করে আসছিল। তাহলে হঠাৎ এই অভ্যুত্থান কেন?
ড. দেলোয়ার হোসেন : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে, বেশকিছু দিন এমন একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শেষ অবধি সেটাই হলো। এনএলডি প্রধান সু চিকে গ্রেপ্তার করল। সম্ভবত কোনো দ্বন্দ্বের কারণে এই অভ্যুত্থান। আমার মনে হচ্ছে, সামরিক বাহিনী সু চির ওপর একটা চাপ তৈরি করল। যেন সেনাবাহিনীর যে ক্ষমতা সেটা যেন সাংবিধানিকভাবে নষ্ট না করা হয়। এটা নিয়ে হয় তো কোনো সংশোধনের কথা উঠেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা কয়েকটা নির্বাচনে দেখল জনগণের ভোট তাদের পক্ষে নেই। এই যে নেই, না পাওয়া এর মাধ্যমে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না।
সামরিক বাহিনী সু চির ওপর একটা চাপ তৈরি করল। যেন সেনাবাহিনীর যে ক্ষমতা সেটা যেন সাংবিধানিকভাবে নষ্ট না করা হয়।
ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি
ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমারের পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে?
ড. দেলোয়ার হোসেন : এটা এখনই বলা কঠিন। সেখানে সামরিক বাহিনী এবং সু চির দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সেই লড়াইয়ে আপাতত সামরিক বাহিনী একটা কঠিন অবস্থানে গেছে। তারা রীতিমতো সামরিক অভ্যুত্থানই করেছে। সেই অভ্যুত্থান অনেক দিকে যেতে পারে; আবার স্থায়ীভাবে সামরিক শাসনের দিকে যেতে পারে অথবা এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে সু চির সঙ্গে আরেক ধরনের সমঝোতায় যেতে পারে। সে কারণে এখন মিয়ানমারের ভেতরে যে বিরোধীদলগুলো আছে তাদের ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরও নির্ভর করছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। তবে সেনাবাহিনী চাইবে ক্ষমতা ধরে রাখার।
ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমারে রাজনৈতিক এমন অস্থিরতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
ড. দেলোয়ার হোসেন : গত তিন বছরে আমরা বহুবার ইতিবাচক অবস্থানে ছিলাম, কিন্তু মিয়ানমার সাড়া দেয়নি। সম্প্রতি চীনের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে শুধু ২৬ বা ২৭ হাজার রোহিঙ্গার বিষয়ে সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। যদিও সেটা এখনও অনেক দূরের বিষয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের এই উদ্যোগ মনে হয় না থেকে যাবে। আমার মনে হচ্ছে, তারা যেহেতু এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটিয়েছে ফলে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর চাপটা আরও বৃদ্ধি পাবে। তারা নিন্দিত ও সমালোচিত হচ্ছে, সে হিসেবে তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন না হলেও ভবিষ্যতে পজিটিভ রেসপন্স করতে পারে। ওদের ওখানে যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে সেটা ওভারকাম করার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। সেদিক থেকে ওই অর্থে আমি মনে করি না যে, হারানোর কিছু ছিল।
মিয়ানমারের ভেতরে যে বিরোধীদলগুলো আছে তাদের ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরও নির্ভর করছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। তবে সেনাবাহিনী চাইবে ক্ষমতা ধরে রাখার।
ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি
ঢাকা পোস্ট : সামরিক অভ্যুত্থান ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যাবে?
ড. দেলোয়ার হোসেন : সু চি ও সামরিক বাহিনী সবাই মিলেই তো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক যে পরিবর্তন সেটা ফিরিয়ে আনতে ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ করবে। মিয়ানমার আবারও সামরিক শাসনের দিকে যাচ্ছে সেটা এই অঞ্চলের জন্য হুমকি। সেদিক বিবেচনা করলে আমার মনে হয়, আন্তর্জাতিক মহলের চাপটা আগের চেয়ে বাড়ার সম্ভাবনা আছে। মিয়ানমার নিজেই সেই সুযোগটা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও চাপ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ তো যেকোনো মূল্যে প্রত্যাবাসন চায়। এই পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
ড. দেলোয়ার হোসেন : মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর বিকল্প নেই। যাতে মিয়ানমারের ওপর চাপটা বাড়ানো যায় সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। এতে রোহিঙ্গা ইস্যুটা অদূর ভবিষ্যতে একটা ইতিবাচক প্রভাবও নিয়ে আসতে পারে। চীনের সঙ্গেও অব্যাহত যোগাযোগ করে যেতে হবে, ভারতকেও সঙ্গে রাখতে হবে।
মিয়ানমার আবারও সামরিক শাসনের দিকে যাচ্ছে সেটা এই অঞ্চলের জন্য হুমকি। সেদিক বিবেচনা করলে আমার মনে হয়, আন্তর্জাতিক মহলের চাপটা আগের চেয়ে বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও চাপ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি
ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান দেশটির গণতন্ত্রের জন্য হোঁচট বলা হচ্ছে। কিন্তু সু চির দল ক্ষমতায় থাকলেও দেশ পরিচালনা তো সামরিক বাহিনী করছিল। এ বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. দেলোয়ার হোসেন : মিয়ানমারের যে অবস্থা ছিল, সেটা তো সীমিত গণতন্ত্র। সরাসরি না করেও সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ভোগ করছিল। এখন তারা সরাসরি সামরিক শাসনে চলে গেছে। সেই অর্থে সীমিত যে গণতন্ত্র সেটাকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল সেটা বলা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সামরিক বাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত; এক দিকে সামরিক বাহিনী অন্যদিকে কট্টর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। গণতন্ত্রের জন্য ভালো পরিবেশ কখনওই মিয়ানমারে ছিল না। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গুরত্বপূর্ণ। সেটার ডেভেলপমেন্টের সুযোগ ছিল, সেই সুযোগগুলো এখন আর নেই। মনে হচ্ছে, ওরা চাইবে ৬২ সালে যে অবস্থায় ছিল সেই দিকে ফিরে যেতে।
ঢাকা পোস্ট : রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে রায়ের বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন?
ড. দেলোয়ার হোসেন : আন্তর্জাতিক আদালতে যে রায় হয়েছে, সেটা সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে না। এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন রায়। যারা এখন ক্ষমতায়, তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার রায়। ফলে এটা মিয়ানমারের জন্য আরও লজ্জাজনক হবে। কারণ আন্তর্জাতিক আদালতের হাতে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রমাণ আছে, এতে সেই প্রক্রিয়াগুলো আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার নিন্দিত ও সমালোচিত হচ্ছে, সে হিসেবে তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন না হলেও ভবিষ্যতে পজিটিভ রেসপন্স করতে পারে। ওদের ওখানে যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে সেটা ওভারকাম করার জন্য অনেক কিছু করতে পারে।
ড. দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি
ঢাকা পোস্ট : চীন বলেছে, তারা মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। দেশটি মিয়ানমারের এই পরিস্থিতিতে কোনো ভূমিকা রাখবে?
ড. দেলোয়ার হোসেন : চীন বলছে, দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। আমরা আশা করছি, চীন বিষয়টি সমাধানে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্য এসব করবে হয় তো। যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাবে তখন হয় তো দেখা যাবে চীন সেটার বিরোধিতা করছে। সেটার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমার ইস্যুতে ভারত নিন্দা জানিয়েছে। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. দেলোয়ার হোসেন : চীন বা ভারত নিন্দা জানাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে তারা এটার বিরোধিতা করছে। এটা আমাদের একটা শক্তি। মিয়ানমারকে এতদিন যারা সমর্থন দিয়ে আসছে তারাও নিন্দা জানাচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও গুরুত্ব পাবে।
এনআই/এফআর