নারীর অধিকার আদায়ে প্রতিবাদী একটি নাম আয়শা খানম। তিনি নারী আন্দোলনের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন কথায় নয়, কর্মে-আন্দোলনে। শুধু নারী আন্দোলন নয়; সব শ্রেণির নাগরিকের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সবাইকে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য প্রয়াস করে গেছেন।

নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক সভাপতি আয়শা খানমের প্রথম প্রয়াণ দিবসে ‘শ্রদ্ধায় স্মরণে আয়শা খানম’ শীর্ষক স্মরণ সভায় এ কথা বলেন বক্তারা।

সোমবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে এ স্মরণ সভা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়।

স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভার শুরুতে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, এমপি থাকাকালীন সময় (১৯৯৬-২০০০) থেকে আয়শা খানমকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। যখন নারী ইস্যুতে কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি তখন তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে এককভাবে জোরালো ভূমিকা রাখেন।

নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন সংস্কারে সরকারের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আন্দোলন, সংগ্রাম ও নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে আয়শা খানম একটি অনন্য নাম হয়ে থাকবে।

ব্যরিস্টার সারা হোসেন বলেন, নতুনদের কাজ করার সুযোগ দিতেন তিনি সবসময়। বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট উপস্থাপনের মাধ্যমে মানবাধিকার ইস্যুতে নতুন ধারণা উপস্থাপন করতে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। 

সূচনা বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনকে কাজের মূূল ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানম। নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে আয়শা খানমের সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মদক্ষতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, বহুমুখী কর্মপ্রয়াস জাতীয় ও বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের ইতিহাসে তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, আয়শা খানম বিরল মানুষদের একজন যিনি তারুণ্যে নেওয়া সংকল্পকে পূর্ণ করতে আমৃত্যু কাজ করেছেন। নারীবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যেসব মানুষ নিরলসভাবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। তার মতামত তিনি কারো উপর চাপিয়ে দেননি। বরং এমনভাবে কাজ করতেন যা সবাইকে অনুপ্রাণিত করত।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টিটিভ সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, আয়শা খানম একজন দৃঢ়চেতা, মানবিক গুণসম্পন্ন নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন। আজকে তার প্রয়াণ দিবসে আমরা শোক করব না বরং কর্মময় জীবনের উদযাপন করব। ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীদের উন্নয়নে, জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায়, নারীবান্ধব আইন প্রণয়নে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আয়শা খানম অন্যতম। তিনি সরকারের সঙ্গে ইউএনডিপিকে নারীবান্ধব বিভিন্ন কর্মকৌশল গ্রহণে তার মূল্যবান মতামত দিয়ে সবসময় সহযোগিতা করেছেন।  

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সমাজ পরিবর্তনের উন্নয়নে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আয়শা খানম, বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সময় থেকে গুরুত্বপূর্ণূ। নারী আন্দোলনের রোল মডেল হিসেবে তিনি আমাদের সবার কাছে পরিচিত, শুধু নারী আন্দোলন নয় সব শ্রেণির নাগরিকের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সবাইকে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য প্রয়াস করে গেছেন।

মনি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট্রের সভাপতি শেখর দত্ত বলেন, দেশের নারী জাগরণের আন্দোলনে আয়শা খানমের অবস্থান ও অবদান তুলে ধরে বলেন ৬০ এর দশকে জাতীয় জাগরণ যত অগ্রসর হয় তত নারী আন্দোলনও অগ্রসর হতে থাকে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নারী অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে আয়শা ছিলেন অন্যতম। 

বিপ্লবী নারী আন্দোলনের সঙ্গে সংস্কার পরিবর্তনের ধারার আন্দোলনকে যুক্ত করে এগিয়ে নিতে এবং কেন্দ্র থেকে জেলার দল, মত নির্বিশেষে সব নারীদের একত্রিত করে আন্দোলন চালিয়ে নিতে আয়শা খানমের অবদান স্বার্থক।

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, সম্মিলিত নারী সমাজের মাধ্যমে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে আয়শা খানমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠনের পর নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে আন্দোলনের পথ তৈরিতে তিনি সহায়তা করেন। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আদর্শকে ধারণ করে আগামী দিনে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আয়শা খানম যে দ্বীপ জালিয়ে গেছেন তা কীভাবে আরো প্রজ্জলিত করা যায় তা আলোচনার জন্য আজকের এই স্মরণসভা। যে ব্রত নিয়ে তিনি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিকে আসেন, সেই একই ব্রত নিয়ে তিনি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। 

প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় করে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে আয়শা খানম অন্যতম। বিপ্লবী, সাহসী নেত্রীদের যুক্ততা ও নেতৃত্বের কারণে কারণে মহিলা পরিষদ একটি গৌরবের জায়গা অর্জন করে, এখানেও তার অবদান রয়েছে। 

নারী আন্দোলনসহ সব সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ছিলেন। নারীর মানবিক মর্যাদা, নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সংগঠনের যে যাত্রা শুরু হয় সেখানেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাজ করার জন্য সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরির দিকেও তার তীক্ষ্ম নজর ছিল। এই প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিটি আন্দোলনকে সমন্বয় করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পাশাপাশি সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদের নিয়ে রাজনৈতিক কক্কাস তৈরিতে তার একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করতে হলে আয়শা খানমের দেখানো পথ অনুসরণ করে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

স্মরণসভার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। অনলাইন স্মরণসভায় সংগঠনের সহ-সভাপতি মাখদুমা নার্গিস, নাজমুন নাহার, হান্নানা বেগম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম সহ সম্পাদকমণ্ডলী, ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি তপতী সাহা, বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের মধ্যে নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিনা গোস্বামী উপস্থিত ছিলেন।

জেইউ/জেডএস