বিগত বছরগুলোর মতো সশস্ত্র জঙ্গি হামলার চিত্র ছিল না ২০২১ সালে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে জঙ্গি ও উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে। এ কারণে অনলাইন প্লাটফর্মের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সেখানে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

২০২১ সালে উগ্র ও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকা কিংবা প্রচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ৪২৯ জন। যাদের অধিকাংশই এখন কারাগারে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত দুই/তিন বছরে জঙ্গি তৎপরতা কমে এসেছে। এরপরও আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। যারা জামিনে আছেন, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কয়েক স্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সীমিত পরিসরে কাজ করে যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত দুই/তিন বছরে জঙ্গি তৎপরতা কমে এসেছে। এরপরও আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। যারা জামিনে আছেন, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কয়েক স্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে

র‍্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ২৭৩ জঙ্গিকে গ্রেফতার, নয় জঙ্গি ‘আত্মসমর্পণ’ এবং বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করে র‍্যাব।

র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার আনসার-আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবী / ছবি- সংগৃহীত

র‍্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র‍্যাব জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এখন পর্যন্ত পূর্ববর্তী ধারা সমুন্নত রেখে র‍্যাব বহুমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র অভিযান নয়, জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়তে এবং জনসম্পৃক্ততা অর্জনে র‍্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রেফতারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরকপ্রাপ্তি বন্ধে র‍্যাবের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

‘এছাড়া র‍্যাব জঙ্গি আত্মসমর্পণে বিশেষ উদ্যোগ ‘র‍্যাব ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মাধ্যমে পুনরায় জঙ্গিরা তাদের সংগঠনের অস্তিত্বের জানান দেয়। হলি আর্টিজান ঘটনা-পরবর্তী র‍্যাব জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতারে সক্রিয় হয়। জঙ্গি সংগঠনের আমিরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাফল্যও পায়।’

র‍্যাবের অভিযানে কেন্দ্রীয় দাওয়াতি শাখাপ্রধান, শুরা ও শরিয়া বোর্ড সদস্য, মহিলা শাখার নেতৃবৃন্দ এবং বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ গ্রেফতার হয়। এর মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনকে দুর্বল করে দেয় র‍্যাব— বলেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

হলি আর্টিজান হামলার পর র‍্যাবের তৎপরতায় ১৫৫৮ জঙ্গি সদস্য আটক হয়। এর মধ্যে ৮৩১ জন জেএমবি সদস্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজার ৬৮৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। এর মধ্যে জেএমবি সদস্য ছিলেন ১৩৯৬ জন— জানায় র‍্যাব।

২০২১ সালে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার ২৮৫ জঙ্গি

র‍্যাব সদর দপ্তর জানায়, ২০২১ সালে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ২৮৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। এর মধ্যে জেএমবি সদস্য ছিলেন ৮২ জন। উদ্ধার করা হয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই ও লিফলেট।

২০২১ সালে র‍্যাবের উল্লেখযোগ্য অভিযান

গেল বছরের (২০২১ সাল) ১৫ জুলাই র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানী ঢাকার শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে আনসার-আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসান ওরফে গুনবীকে (৩৬) গ্রেফতার করা হয়।

গত ৪ সেপ্টেম্বর সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৪ এর অভিযানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে জেএমবি’র সক্রিয় সদস্য জুলহাস উদ্দিন ওরফে কাদেরী ওরফে মেহেদী (৩৪), মোহাম্মদ রোবায়েদ আলম ওরফে ধ্রুব (৩৩), আলাল ওরফে ইসহাক (৪৮) ও আবু আইয়ুব ওরফে খালিদ (৩৬) ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে গ্রেফতার জেএমবি’র সক্রিয় চার সদস্য / ছবি- সংগৃহীত

গত ৯ সেপ্টেম্বর র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব- ২ এর অভিযানে রাজধানীর বসিলা থেকে জেএমবি’র একটি চক্রের কর্ণধার এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে (৫৫) গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে জব্দ করা হয় অস্ত্র, গুলি, নগদ অর্থ, রাসায়নিক দ্রব্য ও অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট।

গত ৪ ডিসেম্বর র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৩ এর অভিযানে নীলফামারী সদরের মাঝাপাড়া থেকে জেএমবি’র নীলফামারী ও রংপুর অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান আহিদুল ইসলাম ওরফে আহিদ ওরফে পলাশ (২৬) এবং তার অন্যতম সহযোগী ওয়াহেদ আলী ওরফে আব্দুর রহমান (৩০), আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডা. সুজা (২৬), জাহিদুল ইসলাম জোবায়ের (২৭) ও নূর আমিন ওরফে সবুজ (২৮) গ্রেফতার হন। অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য, পিস্তল, ম্যাগজিন ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে র‍্যাবই প্রথম জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ  নেয়। শুরু হয় বিপথগামী জঙ্গি সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা। র‍্যাব ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি) সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে চায়। র‍্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়াতে আত্মসমর্পণ করে সাত বিপথগামী তরুণ।

জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে নয় ব্যক্তির আত্মসমর্পণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন / ছবি- সংগৃহীত

২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘নবদিগন্তের পথে’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ছয় জেএমবি ও তিন আনসার-আল ইসলামের সদস্যসহ মোট নয় জঙ্গি ‘বিনা শর্তে’ আত্মসমর্পণ করে। পুনর্বাসনের জন্য তাদের প্রত্যেককে র‍্যাবের নিজস্ব তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি ট্রাক্টর, গরুর খামার, বাইসাইকেল ইত্যাদি সহায়তা দেওয়া হয়।

সিটিটিসির অভিযানে ১০০ জঙ্গি গ্রেফতার

উগ্র ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০২১ সালে ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অভিযানে ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে আনসার-আল ইসলামের ৫০ জন, নব্য জেএমবির ১৫ জন, হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশের চারজন, আল্লাহর দলের একজন, হিযবুত তাহরীরের ১১ জন, জেএমবির ছয়জনসহ সন্দিগ্ধ ও অন্য জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৩ জন গ্রেফতার হন।

গত ৪ ডিসেম্বর বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ নীলফামারীর মাঝাপাড়া থেকে গ্রেফতার জেএমবি সদস্যরা / ছবি- সংগৃহীত

এ বিষয়ে সিটিটিসি’র ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ তৎপরতা কমেছে। তবে অনলাইন তৎপরতা রয়েছে। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোর তৎপরতা সিটিটিসির বিভিন্ন ইউনিট মনিটরিং করছে। এটা আরও জোরদার করা হয়েছে।

ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এটা সীমিতভাবে করা হচ্ছে। তবে যারা উগ্র ও জঙ্গিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছেন তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে বিপথ থেকে ফিরে আসার জন্য।

গত ১১ জুলাই নারায়ণগঞ্জের নোয়াগাঁও এলাকায় একটি জঙ্গি আস্তানায়ে সিটিটিসির অভিযান / ছবি- সংগৃহীত

‘যারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে কিংবা জামিনে বের হয়ে আসছেন, তাদের নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশকে তাদের গতিবিধি মনিটরিংয়ের জন্য বলা হচ্ছে।’

এটিইউ’র ৩৫ অভিযানে ৫৬ উগ্রবাদী গ্রেফতার

২০২১ সালে উগ্র ও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ৩৫টি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মোট ৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে জেএমবি সদস্য সাতজন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ২১ জন, আল্লাহর দলের পাঁচজন, হিযবুত তাহরীরের তিনজন, আনসার-আল ইসলামের ১০ জন, অনলাইন প্রতারক পাঁচজন এবং হেফাজতে ইসলামের চার সদস্য রয়েছেন।

এটিইউ'র পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভুল বুঝে কিংবা ভুল পথে পা বাড়িয়ে জঙ্গি-উগ্রবাদে জড়ানো তরুণ-যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজের অংশ। কাজটা এটিইউ সুষ্ঠুভাবে করছে। তবে সরকারিভাবে অর্থায়ন না থাকায় যেভাবে করা দরকার সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। মনিটরিং, অভিযান, গ্রেফতারসহ নানা আইনি পদক্ষেপ বাড়ানো হয়েছে।’

জেইউ/এমএআর/এমএইচএস