বাবা হারানোর দিন কয়েক পরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন পাঁচ ভাই। একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরেক ভাই রক্তিম সুশীল। তিনি এখন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে (ভেন্টিলেটর) আছেন। তার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। স্বজনরা বলছেন, প্রতিদিন তার চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে ১৬-১৭ হাজার টাকা। এই ব্যয় তারা আর বহন করতে পারছেন না।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি রক্তিম সুশীলের অবস্থা খারাপ। তিনি বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ পাওয়া সাপেক্ষে স্থানান্তর করা হবে। রক্তিমের চিকিৎসার সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি, চমেক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি রোববার তাকে চমেকে পাঠানো যাবে।

তিনি বলেন, রক্তিমের চিকিৎসার জন্য নিউরোসার্জারির মতামতের কিছু বিষয় আছে, যা জেনারেল হাসপাতালে হবে না। তাই তার উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিউরোমেডিসিনসহ অন্যান্য চিকিৎসক মেডিকেলে সবসময় পাওয়া যাবে। বর্তমানে চমেকের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় রক্তিম সুশীলের ভাই অনুপম শীল, নিরুপম শীল, দীপক সুশীল, চম্পক সুশীল ও স্মরণ সুশীল নিহত হন। একই দুর্ঘটনায় আহত রক্তিমকে ওই দিনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রক্তিমের শ্যালক অনুপম শর্মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চমেকে ভর্তির দিন দুলাভাইয়ের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। সেখানে না পেয়ে বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানে খরচ অনেক বেশি। ব্যয় বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ম্যাক্সে একদিন রেখে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। বর্তমানে এখানেই চিকিৎসা চলছে। দুলাভাইয়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আমার বোন, ভাগ্নেসহ পুরো পরিবার তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তিনি বলেন, দুলাভাইয়ের (রক্তিমের) চিকিৎসার পেছনে এখন প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। যা চালাতে তার পরিবারের অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিছু মানুষ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। তা উনার চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। যা পাচ্ছি তা দিয়েও চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অল্প অল্প অনুদান পেয়েছি। রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেলে ট্রান্সফার করবে বলে শুনেছি।

রক্তিম সুশীলের স্ত্রী সুমনা শর্মা শান্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অনুপম শর্মা বলেন, দুলাভাইয়ের সড়ক দুর্ঘটনার পর আমার বোন এক প্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। তিনি কথা বলার অবস্থায় নেই। দুলাভাইয়ের সঙ্গে আইসিইউতে আছেন। এ কথা বলেই চুপ হয়ে যান অনুপম।

সদ্য প্রয়াত বাবা সুরেশ চন্দ্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাট এলাকায় পিকআপ ভ্যানচাপায় পাঁচ ভাই অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯) নিহত হন। ঘটনার ১০ দিন আগে তাদের বাবা সুরেশের মৃত্যু হয়। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন। স্থানীয় একটি মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে ৯ ভাই-বোন (৭ ভাই ও ২ বোন) হেঁটে বাড়িতে আসার জন্য সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই একসঙ্গে চার জনের মৃত্যু হয়, বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক ভাই।

এ ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান সুরেশ চন্দ্র সুশীলের মেয়ে মুন্নী সুশীল। আহত হন আরও দুই ছেলে ও এক মেয়ে। নিহতদের বোন হীরা শীল মালুমঘাট খ্রিষ্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে।

নিহতদের বোন মুন্নী সুশীল বলেন, ঘটনার সময় অন্য ভাই-বোনদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। আমরা মৃত বাবার জন্য পূজা শেষে বাড়ি ফিরতে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখনই পিকআপটি ধাক্কা দেয়। পিকআপটি প্রথমে ধাক্কা দিয়ে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। পরে চালক গাড়ি পেছনের দিকে চালিয়ে এনে চাপা দিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে পাঁচ ভাইকে চাপা দেওয়া পিকআপ ভ্যানের চালক সাহিদুল ইসলামকে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আটক করেছে র‌্যাব। তাকে আটকের পর র‌্যাব জানায়, ঘটনার দিন রাস্তায় অতিরিক্ত কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও চালক দ্রুত কক্সবাজার পৌঁছে সবজি ডেলিভারি দিতে বেপরোয়াভাবে পিকআপটি চালাচ্ছিলেন। ঘন কুয়াশা ও অতিরিক্ত গতির কারণে মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারতদের দূর থেকে খেয়াল করেননি তিনি। গাড়ি অতিরিক্ত গতিতে থাকায় কাছাকাছি এসে লক্ষ্য করলেও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।

কেএম/এসএসএইচ