দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের অপসারণের বিষয়টি দেশজুড়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্নও উঠছে। দুদক বলছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং অব্যাহতভাবে দুদক আইন ও বিধি পরিপন্থি কাজ করার কারণে তাকে চাকরি থেকে অপসারণের বিকল্প পথ ছিল না।

নিজের বিরুদ্ধে দুদকের তোলা বেশ কিছু অভিযোগ এবং সেসবের ব্যাখ্যা নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হয়েছেন অপসারিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। শনিবার ঢাকা পোস্টকে দেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তিনি। 

অভিযোগ ১

দুদকের চট্টগ্রাম-২ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে একটি মামলার সূত্র ধরে মো. শরীফ উদ্দিন অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব (০৩৯৫৩১০০১৭১৮১) ‘নো ডেবিট’ করতে কক্সবাজার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপককে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (নম্বর-১৫৩৯/২০২১) দায়ের করেন।

২০২১ সালের ২৭ জুন হাইকোর্ট বিভাগ শুনানি শেষে ‘কমিশনের অনুমোদন ব্যতীত কোনো অ্যাকাউন্টের অর্থ নো ডেবিট করার আদেশ দানের ক্ষমতা তদন্তকারী কর্মকর্তার নেই’ মর্মে উল্লেখ করে রিটটিতে ‘রুল অ্যাবসল্যুট’ মর্মে আদেশ দেন। ফলে তার কার্যকলাপ ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরণ ও অদক্ষতার পর্যায়ে পড়ে।

শরীফ উদ্দিনের ব্যাখ্যা

হাইকোর্ট ‘নো ডেবিট’- এর বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এটাকে বৈধ বলার সুযোগ নেই। তবে আমার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না সেটা দেখা উচিত। ‘নো ডেবিট’ হলো এক ধরনের অনুরোধপত্র। এটাকে জব্দ বলা যাবে না। কারণ টাকা ওই হিসাবেই থাকছে। শুধু যার টাকা, তিনি উত্তোলন করতে পারবেন না।

কিন্তু অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছি। এটি কীভাবে সম্ভব? যেহেতু সেটি অরগানাইজড ক্রাইম ছিল, তাই যত দ্রুত সম্ভব টাকা আটকানো দরকার ছিল। যদিও নিয়ম হচ্ছে কমিশনের অনুমোদনক্রমে করা, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাই রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজটি করতে হয়েছে। যা কিছু করেছি তদন্তের স্বার্থে করেছি। যা কিছু করেছি সরল বিশ্বাসে করেছি। সেজন্য চাকরি খেয়ে ফেলতে হবে?

অভিযোগ ২

চট্টগ্রাম-২ এর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (কক্সবাজার ) ২০২০ সালের ১০ মার্চ (মামলা নম্বর- ১) র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) কর্তৃক তালিকামূলে ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন উক্ত টাকা কক্সবাজার সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (নি.) আরফাতুল আলমের নিকট থেকে চালানমূলে গ্রহণ করলেও সরকারি কোষাগারে অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা না করে নিজের কাছে রাখেন।

শরীফ উদ্দিনের ব্যাখ্যা

প্রথমত, টাকা আমি জব্দ করিনি। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব কর্তৃক জব্দ করা হয়। সেখানে অন্যান্য আলামত ছিল। কোভিডকালে আমাদের টিমসহ জব্দকৃত টাকা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসি, যা অফিসিয়াল ভল্টেই রাখি। এ বিষয়ে আমাদের অফিসের উপ-পরিচালক ও পরিচালকরা অবগত ছিলেন। এরপরও জমা দিইনি কেন?  আসলে জব্দকৃত টাকা জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া খুবই জটিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গেলে ব্যাংক আমাদের দুটি অপশন দেয়— প্রথমত, টাকা একটি ভল্টে ভরে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে পারি।  ভেতরে কী আছে, তারা দেখবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের মামলার বিচারকাজ শুরু হওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই ভল্টে ভরে টাকা রাখলে তা দীর্ঘদিনে নষ্ট হয়ে যাবে। পরে যা আদালতে উপস্থাপন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, কমিশন ও আদালতের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করে দেওয়া । সেক্ষেত্রে জব্দকৃত টাকা আর থাকল না। 

আরেকটি বিষয় হলো, ট্রেজারিতে জমা দেওয়া। কিন্তু এটা ডিসি অফিসের অংশ। আর মামলাটি ছিল ডিসি অফিস সংশ্লিষ্ট। তাই আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। কেননা এটি অনেক স্পর্শকাতর মামলা ছিল। ইতোমধ্যে ডিসি অফিসের অনেক আলামত দালালদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলাম। তাই আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। যে কারণে ট্রেজারিতে জমা  দিইনি। তাছাড়া ট্র্যাপ কেসসহ বহু উদাহরণ রয়েছে জব্দকৃত অর্থ কর্মকর্তাদের জিম্মায় রাখার। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের কাছে টাকা রাখা যাবে না, এ ধরনের কোনো বিধি বা আইন নেই। 

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছি।  জব্দকৃত টাকা আমি অফিসকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। তাহলে কীভাবে আত্মসাৎ হলো?  এর জন্য কি আমার চাকরি খেয়ে ফেলতে হবে? এটি আমার জন্য জুলুম বলেই মনে করি।

অভিযোগ ৩

জনস্বার্থে ২০২১ সালের ১৬ জুন সজেকা, চট্টগ্রাম-২ থেকে সজেকা, পটুয়াখালীতে শরীফ উদ্দিনকে বদলি করার দীর্ঘ একমাস পর (১৭ জুলাই) ই–মেইলে তিনি পটুয়াখালীতে যোগদানপত্র পাঠান। ১০ আগস্ট সশরীরে তিনি দুদকের পটুয়াখালী অফিসে উপস্থিত হন। বদলি বাতিলের জন্য একজন আইনজীবীকে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে (১০৫ ( এ -৭ ) / ২০২১ নং)  রিট আবেদন করেন যা ধৃষ্টতার শামিল। হাইকোর্ট রিট আবেদনটি খারিজ করেন। তাছাড়া তার নিয়োজিত আইনজীবীর কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।

শরীফ উদ্দিনের ব্যাখ্যা

২০২১ সালের ৩০ জুন আমাকে চট্টগ্রাম থেকে অবমুক্ত করা হয়। ১০ আগস্ট আমি সশরীরে পটুয়াখালী যোগদান করি। আমার সঙ্গে ২১ জনকে বদলি করা হয়। তারাও দেরি করেছেন, কিন্তু তাদের শোকজ করা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, ওই সময় আমি কী করেছি? মাঝখানের ওই সময় লকডাউন ছিল। সরকারি সব অফিস বন্ধ ছিল। তাছাড়া সার্ভিস রুল অনুসারে আমি তো সময় পাব। এছাড়া আমি তখন কোভিড আক্রান্ত ছিলাম। যার সকল সার্টিফিকেট রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা আমার বিষয়টি পজেটিভলি নিয়েছে। সুতরাং এক মাস ১০ দিন পর কর্তৃপক্ষের আদেশ অবজ্ঞা করে যোগদানের বিষয়টি সঠিক নয়।

অভিযোগ ৪

২০২১ সালের ১৬ জুন সজেকা, চট্টগ্রাম-২ থেকে পটুয়াখালীতে বদলির পর শরীফ উদ্দিন নিজের নিকট রক্ষিত নথিসমূহ যথাসময়ে হস্তান্তর না করে দীর্ঘ আড়াই মাস পর ওই বছরের ২৯ আগস্ট হস্তান্তর করেন।

শরীফ উদ্দিনের ব্যাখ্যা

আমার কাছে ১৩০টি নথিপত্র ছিল। মামলাগুলো অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও হাই-সেনসিটিভ ছিল। ছয়টি আলমারিতে সেগুলো ছিল। তা আরেকজনকে বুঝিয়ে দেওয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। আর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।

পটুয়াখালী থেকে আমাকে ফাইল বুঝিয়ে দিতে আসতে দেওয়া হয়নি। গত ২২ আগস্ট সরাসরি বিভাগীয় মামলা করা হয়, কেন ফাইল বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি এবং ওই আদেশ মূলেই ফাইল হস্তান্তর করা হয়নি। আদেশ পাওয়ার পঞ্চম দিন ফাইল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দেশবাসীর উদ্দেশে শরীফ উদ্দিনের বক্তব্য

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বিষয়ে আমি জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতায় অপসারণকে অসাংবিধানিক মনে করি। আমি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

গুরুত্বপূর্ণ নথি ও মামলা সংশ্লিষ্টরা আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে, যা কমিশনকে অবগত করেছি। আমি আজ অসহায় ও মজলুম। কমিশন ও রাষ্ট্রের কাছে আমি একটি সুযোগ চাই। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রমাণ হওয়ার আগেই আমাকে অপসারণ করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই যদি আমার আকুতি শেষ করে দেওয়া হয়, তাহলে দুর্নীতিবাজদের জয় হবে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।

অপসারণের প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ ২১ জেলায় মানববন্ধন করেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেন তারা।

সচিবের কাছে পেশ করা স্মারকলিপিতে প্রধান বিষয় ছিল- অসাংবিধানিকভাবে ও আদালতে বিবেচনাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিতর্কিত ৫৪ (২) ধারায় উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীনকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিল করা।

এর আগে, ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।

চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে বেশ কিছু বড় দুর্নীতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. শরীফ উদ্দিন। এরপরই একাধিক মহলের রোষানলে পড়েন বলে অভিযোগ ওঠে।

কক্সবাজারে কয়েকটি মেগা প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ, চট্টগ্রাম মেডিকেলে অনিয়ম-দুর্নীতি, কর্ণফুলী গ্যাসে নিয়োগ দুর্নীতি, এনআইডি জালিয়াতি, রোহিঙ্গাদের ভোটার করা নিয়ে দুর্নীতি, ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ গোপন - এসব মামলার সূত্র ধরেই আলোচনায় আসেন শরীফ।

সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি পরিবারসহ হত্যার হুমকি পান শরীফ উদ্দিন। হুমকি পাওয়ার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সিসি টিভির ফুটেজসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।

আরএম/আরএইচ