ছবি : সংগৃহীত

অপারেশন ক্লিন হার্ট চলছে। বাস্তবে ক্ষমতায় সামরিক বাহিনী না বিএনপি, তা ঠিক বোঝা মুশকিল। সেনা প্রধান, না সরকার কার নির্দেশে ওই অপারেশন চলছে তাও পরিষ্কার নয়। সামরিক অভিযানে গ্রেফতার হওয়া মানুষের মৃত্যু ততদিনে চল্লিশ পার হয়ে গেছে। সকলে হার্ট ফেল করে মারা যাচ্ছে। মানুষ গুলি খেলেও শেষ অবধি হার্টটি ফেল করলে তবেই তো মারা যায়। তাই ডাক্তারি ভাষা হোক, আর সরকারি ভাষা হোক সেদিক থেকে ঠিক আছে। 

এ সময়ে একদিন বিকেলে এম আর আকতার মুকুল ভাই-এর সাগর পাবলিশার্সে, কলিম শরাফী ভাই, গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইসহ আরও অনেকে আছেন। সকলের সেদিনের আলোচনা, এর মাত্র দুইদিন আগে অপারেশন ক্লিন হার্ট-এর অপারেশনের নামে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল বন্ধ করে দিয়েছে। সেটা সিলগালা করেছে সেনাবাহিনী এসব বিষয় নিয়ে।

সকলের ধারণা এ বিষয়ে আমার কাছে বাড়তি খবর আছে। বাস্তবে বাড়তি খবর বলতে ওই সময়ে সারা হোসেনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি ড. কামাল হোসেন কোনো একটা মৃত্যু নিয়ে হাইকোর্টে এই অপারেশন ক্লিন হার্টের বিরুদ্ধে রিট করতে যাচ্ছেন। তারা কেউ এই খবর পেয়ে খুব বেশি খুশি হলেন না। কারণ, সকলেই সামিরক শাসন, আধা সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন সবকিছুই পার করে এসেছেন। তারা জানেন এই সময়ে কোর্ট কতটুকু কী করতে পারে। তারপরেও যে একটা কিছু হচ্ছে অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে এই বেআইনি হত্যার বিরুদ্ধে তাতে সকলেই যেন কিছুটা হলেও একটু খুশি হলেন। 

এর ভেতরই আমার মোবাইলে ফোন এলো। একটু বাইরে এসে ফোন ধরতেই ওপার থেকে শুধু বললেন, তুমি এখন রিমিদের বাসায় চলে এসো। নিজস্ব যানবাহন নেই। আবার যায়যায়দিনের গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক না। তাই এম আর আকতার মুকুল ভাইকে একটু চোখের ইশারা করে একটা অটো রিকশা নিয়ে রওনা হলাম।

গিয়ে দেখি বেশ শান্তভাবেই বসে আছেন এইচ টি ইমাম ভাই। আমি তাকে ড. কামাল হোসেন একটা রিট করতে যাচ্ছেন বলতেই তিনি বলেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম তাকে জানিয়েছেন। তারপরে তিনি বলেন, দেখ আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা মুহিত ভাইকে (আবুল মাল আব্দুল মুহিত) গ্রেফতার করতে পারে। কারণ, তার রিগ ইলেকশন বইটার কারণে পশ্চিমা কূটনীতিকরা এখন সকলে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাই ওনার কিছুদিনের জন্যে বাইরে গিয়ে থাকাই ভালো। 

দেয়ালে একটা ম্যাপ অবশ্য টাঙানো হয়েছে। সে ম্যাপে বাংলাদেশের সবকটি নির্বাচনী এলাকার সীমানা আঁকা। আর ওই ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে এইচ টি ইমাম, মশিউর রহমান, নূহ-উল-আলম লেনিন ও আমি।

ঠিক বুঝতে পারি না, আমাকে ডেকে তিনি কেন এ কথা বলছেন। তারপরও ধৈর্য নিয়ে তার কথা শুনে যাই। কারণ, মানুষটার সঙ্গে পরিচয়ের পরে তাকে যতটা জেনেছি তাতে তিনি অহেতুক কোনো কথা বলেন না। এবং সবসময়ই ভবিষ্যৎ চিন্তা করেন। আর খুবই মেথডিক্যালি কাজ করেন। এখানেও তাই ঘটল।

তিনি তার ছোট ব্যাগটা থেকে একটা নোট বুক বের করে বললেন, লিখে নাও। এই তথ্যগুলো আমার দরকার। লিখে নিলাম। আর তাকে বললাম, তথ্যগুলো পাওয়া কঠিন তবে অসম্ভব নয়। একটু সময় লাগতে পারে। তিনি বললেন, দেখ সাংবাদিক, জেনারেল এদের সময় নিলে হয় না। দ্রুত কাজ করতে হয়। যাও সময় নষ্ট করো না। যেভাবে পার তাড়াতাড়ি এগুলো জোগাড় করো। হেসে বলি, গ্রিনটির কাপটাতো শেষ করে তারপরে যাই। তিনিও হাসলেন। চা খেতে খেতে তাকে জিজ্ঞেস করি, মুহিতভাই যদি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যান তাতে কী কাজ বন্ধ থাকবে? তিনি বলেন না, আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করব। এবং যেকোনোভাবেই হোক আমি কাজ চালিয়ে নিয়ে যাব।

সত্যি তার মাত্র কয়েকদিন পরে তিনি জানালেন, তিনি কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন। ওই অপারেশন ক্লিন হার্টের মধ্যেও মানুষটি বিন্দুমাত্র ভয় পাননি। এবং সেই থেকে তার ওই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সবদিনের অনেক ঘটনা, অনেক ইতিহাস। থাক সেগুলো। 

এরপরের ঘটনা শেখ হাসিনার নিজস্ব অফিস ও এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে নির্বাচনী অফিস ধানমন্ডিতে চালু হওয়ার প্রথম দিনের। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি ৩টার দিকে ধানমন্ডিতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাড়ির সামনে এসো, ওখান থেকে আমি তোমাকে তুলে নেব।

সেখান থেকে ওনার গাড়িতে নতুন অফিসে যাই। তখনো অফিস সাজানো হয়নি। দেয়ালে একটা ম্যাপ অবশ্য টাঙানো হয়েছে। সে ম্যাপে বাংলাদেশের সবকটি নির্বাচনী এলাকার সীমানা আঁকা। আর ওই ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে এইচ টি ইমাম, মশিউর রহমান, নূহ-উল-আলম লেনিন ও আমি।

ম্যাপের ওপরে নাম লেখা ‘উত্তরণ’। লেনিনভাই স্বপ্রণোদিত হয়েই আমাকে বললেন, স্বদেশ উত্তরণ নামটি নেত্রী নিজে দিয়েছেন। কিন্তু আমার চোখ সে সময়ে ওই ম্যাপে আটকে আছে। বিশাল বাংলাদেশের মধ্যে মাত্র ৫৪টি স্থানে আওয়ামী লীগের চিহ্ন আঁকা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সিট মাত্র ৫৪টি।

আজ এইচ টি ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী। তার সঙ্গে যা কাজের স্মৃতি তা নিয়ে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার ওপরে বই লেখা যাবে। আজ তার কথা বেশি মনে পড়ে যখন চারপাশে শতভাগ অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক মানুষ কমে যাচ্ছে...

যা দেখে সত্যি কেমন যেন একটা হতাশা নেমে এলো মনের মধ্যে। হয়তো চোখেমুখেও তার ছায়া পড়েছিল। আর সেটি পড়তে পেরে, এইচ টি ইমাম ভাই বললেন, স্বদেশ মনে হয় কোনো কিছু নিয়ে হতাশ হচ্ছো? তার দিকে তাকিয়ে বলি, এই ৫৪ থেকে ১৫১’র ওপরে কীভাবে যাবেন? তিনি মৃদু হাসলেন। তারপরে বললেন, এই প্রশ্নটি তুমি নেত্রীকে করো। আমার কাছ থেকে পেলে তুমি সন্তুষ্ট হবে না। তবে তোমার নিজের বোঝা উচিত। তুমি তো সবকিছু দেখছো তাছাড়া সাংবাদিক হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের থেকে বেশি মেশো।

তার কয়েকদিন পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, নেত্রীর কাছ থেকে উত্তর পেয়েছো? মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ। তিনি জানতে চাইলেন, কী বললেন তিনি। আমি বলি, হাসিনা আপা অসম্ভব দৃঢ়তা নিয়ে বললেন, আমাকে শুধু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা দিক। দুশোর ওপরে সিট পাবে একা আওয়ামী লীগ। 

এরপরে তো ১/১১ এলো। সে সময়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে বেশি ব্যস্ত আর এইচ টি ইমাম নির্বাচনী কাজ নিয়ে ব্যস্ত বেশি। এর ভেতর শেখ হাসিনা বিদেশে থাকা অবস্থায় তাকে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

শেখ হাসিনা সে নিষেধাজ্ঞা না মেনে হিথ্রো এয়ারপোর্টে এলে প্রথম দিন তাকে এয়ারওয়েজ নিতে আপত্তি জানায়। এ খবর পাই বনানীর একটা অফিসে বসে, সঙ্গে সঙ্গে হাসিনা আপাকে ফোন করি। তখনো তিনি এয়ারপোর্টে, তার কাছে জানতে চাই এখন তিনি কী করবেন। তিনি তার সেই স্বভাব সুলভ দৃঢ় গলায় বলেন, ‘আমার দেশে আমি ফিরব, ওরা কে আমাকে বাধা দেওয়ার। আমি দেশে আসছি।’ তারপরে তিনি আরও বেশকিছু কথা বলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইমাম ভাইকে ফোন করে জানাই এবং অফিসের দিকে যাই যাতে রিপোর্টে তার একথাগুলো যোগ হয়। এইচ টি ইমাম ভাই সে রাতে আবার তার কাছে যাওয়ার জন্য বলেন। গিয়ে দেখি তিনি বেশকিছু কাগজপত্র নিয়ে মনোযোগের সাথে কাজ করছেন। জানলাম সবগুলোই হচ্ছে হাসিনা আপার নির্দেশে। 

তারপরেও তো দীর্ঘ ইতিহাস তত্ত্বাবধায়কের আমলে। সে সব থাক। যাই হোক, শেষ অবধি তো নির্বাচনের দিন এলো। নির্বাচনী রিপোর্টিং আমার একটা নেশা। তাই অফিসের নয়, নিজের থেকে সারাদিনের জন্য একটা গাড়ি নিয়ে খুব ভোরে বের হয়ে পড়ি। এদিকে মানিকগঞ্জের বহু এলাকা ও মুন্সিগঞ্জের অনেক এলাকা, কেরানীগঞ্জ আর ঢাকার নানান কেন্দ্রে তো যাই। মাঝে মাঝেই ইমাম ভাইয়ের ফোন আসে। মাঠের পরিস্থিতি হয়তো তার হিসাবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল তাই তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হয়নি। 

তারপরে তো নির্বাচনী বিজয়ী সভা হয় চীন মৈত্রী (বর্তমান বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে ওই মুহূর্তে আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক পাশে জিল্লুর রহমান। আরেক পাশে এইচ টি ইমাম। তিনি ওইদিন আমাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আজ আমার সব থেকে খুশির দিন।’ 

আজ এইচ টি ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী। তার সঙ্গে যা কাজের স্মৃতি তা নিয়ে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার ওপরে বই লেখা যাবে। তবে তার প্রথম মৃত্যুদিনে তার স্মৃতিকে স্মরণ করে বলি, জীবনে যে ক’জনের কাছ থেকে মেথডিক্যালি কাজ করা শিখেছি তিনি তাদের একজন। তাই তিন শুধু আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন না। আরও অনেক বেশি। এ কারণেই তার প্রথম মৃত্যুদিনে এই ক্ষুদ্র স্মৃতিচারণ।

আজ তার কথা বেশি মনে পড়ে যখন চারপাশে শতভাগ অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক মানুষ কমে যাচ্ছে। এ সময়ে মনে হয় যদিও তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন, তারপরেও তার মতো শতভাগ আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ এ মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল।

স্বদেশ রায় ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব