স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক সঞ্চারপথের দিকে তাকালে যে উত্থান-পতন চোখে পড়ে, তার আদলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষি। বাঙালি জাতি, বাংলার মানুষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন তার জীবনের সর্বাংশকে সংযুক্ত করেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর, নির্মাণ করেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক পরিচয়; তার সন্তান শেখ হাসিনা— আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী— তেমনি রচনা করেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উদ্ধার মন্ত্র। কী অলৌকিক সমাপতন!

যে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে, নিঃশঙ্ক চিত্তে; সেই রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ-উত্থান-পতনের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে তার সন্তানের জীবনধারাও। এ কারণেই পঁচাত্তর পরবর্তী শকুন সময়ে সারা বাংলাদেশ যখন সামরিকতন্ত্র আর মোল্লা তন্ত্রের অন্ধকারে বন্দি, যখন এই বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার ভূ-লুণ্ঠিত; তখন ঘাতকের বুলেট থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত দুজন সদস্য— শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার জীবনও আবর্তিত হয়েছে ভয়াল সংকটের নাগপাশে।

পথ হারানো বাংলাদেশের রাজনীতিতে নথিভুক্ত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা, হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিপর্যস্ত তরণীর।

প্রবাসে থেকেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠন করেন (১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ টমাস উইলিয়ামস ও নোবেল বিজয়ী রাজনীতিবিদ শন ম্যাকব্রাইডকে সঙ্গে নিয়ে। এই কমিশন গঠনের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে (১৯৮১ সালের ১৭ মে) তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সকল বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনা ফিরে আসেন বাংলাদেশে— যে বাংলাদেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শচ্যুত শাসকগোষ্ঠীর খপ্পরে, যে বাংলাদেশে আইন করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের, যে বাংলাদেশ নিমজ্জিত ছিল যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির নিকষ অন্ধকারে।

এই পথ হারানো বাংলাদেশের রাজনীতিতে নথিভুক্ত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা, হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিপর্যস্ত তরণীর। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার যে রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা কেবল কণ্টকাকীর্ণই ছিল না— সে বন্ধুর পথের পরতে পরতে বিছানো ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ষড়যন্ত্রের জাল।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্নের প্রতিফলন ছিল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলাদেশ; পঁচাত্তর পরবর্তী বিপর্যস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-সন্তান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক গন্তব্য হয়ে উঠেছিল পিতার সেই স্বপ্ন— দুজনেই শর্তহীন আস্থা রেখেছিলেন জনগণের ওপর— যে জনগণ সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী, সেনা-আধিপত্যবাদী উঠতি মধ্যবিত্ত কিংবা ফড়িয়া ব্যবসাদার নয়; বরং এই জনগণ তারাই— বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। এই শোষিত জনগণের দিকভ্রান্ত জনমনস্তত্ত্বকে সঙ্গে নিয়েই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন শেখ হাসিনা।

১৯৮১ থেকে ১৯৯৬— এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নানা রাজনৈতিক বাস্তবতা তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। বারবার তাকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। এমনকি পঁচাত্তরের পর ২১ বছরে যে দুটো প্রজন্ম বড় হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্তিনের তলায়— সেই বিভ্রান্ত, ইতিহাস বিমুখ, উচ্চাভিলাষী প্রজন্মের সামরিক ও প্রশাসনিক নানাবিধ ষড়যন্ত্রের জাল তাকে ছিন্ন করতে হয়েছিল এবং এখনো হয়।

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তখন আমরা দেখেছি কী নারকীয় ষড়যন্ত্রে তাকে হত্যার নীলনকশা আঁকা হয়েছিল খোদ রাষ্ট্র প্রধানের বাসভবন থেকে।

করোনা মহামারির বিপর্যস্তকালেও তিনি যেভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তা আমাদের মতো জনবহুল দেশে বেশ চ্যালেঞ্জিং।

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা নিজে বেঁচে ফিরলেও তিনি হারিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের অনেক সহযোদ্ধাকে। ঘাতকরা কেন এই গ্রেনেড হামলার কুৎসিত পরিকল্পনা করেছিল, তার কারণ স্পষ্ট হয় ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন সরকার গঠিত হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার, আইন করে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা, সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে আজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে অগ্রযাত্রার মিছিলে বাংলাদেশ শামিল হয়েছে, তাকে নস্যাৎ করাই ছিল একুশে আগস্টের ঘাতকদের ষড়যন্ত্র।

গত এক যুগেরও অধিক সময় ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের সময় তাকে আন্তর্জাতিক নানা চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তখন অনেকেই ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে’ জাতীয় জুজুর ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে, এখনো বিচার চলছে এবং সেই সঙ্গে চলছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির সফল অগ্রযাত্রা। এই করোনা মহামারির বিপর্যস্তকালেও তিনি যেভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তা আমাদের মতো জনবহুল দেশে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তার হাত ধরেই তথ্য প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। বাংলায় দেওয়া সেই অনবদ্য ভাষণে আমরা আসলে ৫০ বছরের সক্ষম, মাথা উঁচু একটি বাংলাদেশকে দেখতে পেয়েছি। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে (১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, শোষিত মানুষের কথা, ৪৭ বছর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে প্রতিনিধিত্বের স্বরে উঠে এসেছে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন।

করোনামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তিনি টিকার প্রাপ্যতা বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন, তা তো পৃথিবীর শতকোটি শোষিতেরই কণ্ঠস্বর। তিনি তাদেরই দাবির কথা উচ্চারণ করেছেন।

যে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সে দেশ আজ তার সন্তান শেখ হাসিনার হাত ধরে পৃথিবীর শোষিত মানুষের পক্ষে এক সক্ষম ও কার্যকর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। এই মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশই তার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।

শুভ জন্মদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার