ছবি : সংগৃহীত

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের আরবি, ফারসি এবং উর্দু-হিন্দি ভাষার কবিকুল একনিষ্ঠভাবে বন্দনা করে গিয়েছেন পর্দার। প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের তীব্র মিলনেচ্ছা বা আশিকের সঙ্গে মাসুকের একান্ত মিলনকে ব্যক্ত করতে বারবার উঠে আসে পর্দার প্রসঙ্গ। এই বাধাটুকু অতিক্রম করতে পারলে যে অধরা মাধুরী ছন্দবন্ধনে ধরা দিতে পারে, মূর্ত হয়ে উঠতে পারেন সকল দেখার শ্রেষ্ঠ অদৃষ্ট — এমন কথা লিখে গিয়েছেন একের পর এক সুফি দার্শনিক কবিরা।

ছাপ-তিলক সব ছেড়ে নয়নে নয়ন মিলিয়ে তাকানোর কথা লিখে গিয়েছেন স্বয়ং আমির খসরু (ত্রয়োদশ শতক)। নেকাব সেখানে নেই। লজ্জার কোনো স্থান নেই পরম আর তার মিলনাকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত ভক্তের মাঝখানে। সে দর্শনে মিশে যায় কালো যমুনার ছলোচ্ছল ঢেউ, রাধারানীর আব্রু, না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে জেগে থাকে ‘কাওয়াল’-এর উচ্চারণ শুধু।

পৃথিবীর অনেক কিছুর সাথেই সময়ও বদলেছে। রাজনৈতিক হাতবদলের বিবর্তনে এখন হিজাব, নেকাব আর বোরকা ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক বাচনের হাতিয়ার। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই ‘পর্দা’ এমন কিছু মহিমায় উপস্থাপিত, যার নান্দনিকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

ইতিহাসবিদরা বলছেন, ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই পর্দার ব্যবহার প্রচলিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ যে পর্দার প্রচলন ছিল, তা সেই সময়কার বেশকিছু প্রত্নমূর্তি থেকে জানা যায়। পরে ইহুদি, খ্রিস্টীয় ও ইসলাম— তিনটি সেমিটিক সমাজেই তার প্রচলন বহমান থাকে।

অটোমান তুর্কিদের আমলে আভিজাত্য ও উচ্চ রুচিবোধের প্রতীক হিসেবে নেকাব, হিজাব ও বোরকার প্রচলন জনপ্রিয় হয়। ‘মুহাজিবা’-রা (হিজাব পরিহিতা নারী) থেকে যান এক দূর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। সুফিবাদ সেই নন্দনতত্ত্বকেই নিয়ে যায় আধ্যাত্মিক স্তরে।

পর্দা কেবল সত্য আর বিভ্রমের মাঝখানের ব্যবধান হয়েই থাকেনি, সুফি কবিতায় এবং গানে তা ব্যঞ্জনা পেতে থাকে বিরহীর অন্তর্বেদনার আড়াল এবং একই সঙ্গে শুধু মাত্র পরমের সামনে নিজের অন্তরের সৌন্দর্যকে ব্যক্ত করার প্রতীক হিসেবে। নশ্বর মানুষ সেখানে বাহুল্য, লোকসমাজ সেখানে গৌণ।

এই হিজাব আসলে কী বা এর ইতিহাসের দিকে আমরা যদি নজর দেই তাহলে দেখা যাবে, হিজাব হলো একটি বিশেষ ধরনের স্কার্ফ বা পোশাক যা মুসলিম মহিলারা তাদের চুল বা শরীর ঢেকে রাখার জন্য জনসমক্ষে বা বাড়িতে অপরিচিত পুরুষদের কাছ থেকে শালীনতা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখতে পরিধান করে। ধারণাটি ইসলামের বাইরেও অন্যান্য ধর্ম যেমন ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্ম পালনকারীদের মধ্যেও দেখা যায়।

যদিও হিজাব পরার ঐতিহ্য ইসলামে গভীরভাবে প্রোথিত, এ সম্পর্কে পবিত্র কোরানের সূরা আল আহজাবের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার কন্যাদের এবং মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের বাহ্যিক পোশাক নিজেদের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পরিধান করে। এটিই তাদের পরিচয়ের অধিকতর উপযুক্ত হবে এবং তাদের কোনো অমর্যাদা হবে না। আর আল্লাহ সর্বদা ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’

একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সমাজের কাছে প্রশ্ন রাখতেই পারে যে, কোন ধর্মের মানুষ যদি অন্যকে কোনো প্রকার ক্ষতি বা সমস্যা না করে নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় বা পালন করে তাতে ওই সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের কীই-বা সমস্যা হয়?

ভারতে পর্দা প্রথার সূচনা দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হওয়াটাকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়। ভারতে প্রায় সর্বত্রই এই প্রথার কমবেশি দেখা মেলে তবে বিশেষ করে রাজস্থানের রাজপুত সমাজে এই প্রথা বেশি প্রচলিত। স্বাধীনতার পর শহরাঞ্চলে পর্দা প্রথাকে কিছুটা কম গুরুত্ব দেয়া হলেও আজও গ্রামে একই অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তবে সম্প্রতি কর্ণাটকে স্কুল-কলেজে হিজাব পরে আসা যাবে না, এই দাবিতে পথে নেমেছিল কর্ণাটকের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।

প্রথমে কিছুটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান থাকলেও তা ক্রমশ হিংসাত্মক আকার ধারণ করে পুরো ভারতেই তা নিয়ে ব্যাপক হট্টগোল চলছিল যা এখনো পুরোপুরি মীমাংসা হয়নি। এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলন প্রসঙ্গে বিরোধী কংগ্রেস দলের রাজ্য বিধানসভার সদস্য কানিজ ফাতিমা মেয়েদের সমর্থনে কালবুর্গি শহরে একটি বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে হিজাব পরেন এবং এটাকে একজন মুসলিম মহিলার জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসাবে দেখেন।

হিন্দু অতি-ডান গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে তিনি আল জাজিরাকে বলেন, আমরা কোনো সমস্যা ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে হিজাব পরিধান করে আসছি কিন্তু এখন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো হঠাৎ করেই বিষয়টি তুলে নিয়েছে।

আসলে বিষয়টি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে ভারতের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে বিতর্ককে নতুন করে তুলেছে। মুসলমানরা বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে মুসলমানদের এবং তাদের ধর্মীয় প্রতীকের বিরুদ্ধে হামলা বেড়েছে। হিজাব নিষেধাজ্ঞা এসেছিল বেঙ্গালুরুর ভারতীয় আইটি হাবে যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, প্রধানত মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা রাজ্যের ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবেই রাজ্যের হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে গোহত্যা এবং ধর্মান্তর বিরোধী আইন পাস করেছে।

যাই হোক, শাসক বিজেপি ‘হিজাব’ ইউনিফর্মের নিয়ম লঙ্ঘন করে যুক্তি দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞাকে রক্ষা করেছে। যেটি আসলে একটি উগ্রবাদী ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। দলের মুখপাত্র গণেশ কার্নিক আল জাজিরাকে বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধর্ম পালনের জায়গা নয়। মেয়েদের অবশ্যই শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং পরিচয় জাহির করার জন্য নয় পড়াশোনা করতে কলেজে আসতে হবে।  যদিও দেখা যায় ভারতের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মা সরস্বতী থেকে শুরু করে অনেক দেবদেবীর বড় ছবি বা মূর্তি দেখা যায়।

নিয়ম করে ধর্মীয় পূজা-অর্চনাও চলে, এর দোহাই দিয়ে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তি করানোও হয় না। প্রয়োজনে নিয়ম করে তাদের শাখা, সিঁদুর, পাগড়ি অন্যান্য ধর্মীয় পোশাকও পরিধান করেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে তো অন্য ধর্মের লোকজনদের কোনোদিন কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায় না।

ভারতবর্ষ তো আসলে সকল ধর্মবর্ণের মানুষকে নিয়ে চলার কথা। সেই ব্যাপারটা কি আর ঠিক থাকছে? আন্দোলনকারীরা বলছে গত ৩০ বছর ধরে, কলেজে হিজাব নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। কেন হঠাৎ সমস্যা হলো, কীসে এর সূত্রপাত হলো? 

আবার একটু পেছনে ফেরে দেখা যাক, ১৯৯২-এ ঘটে গেল বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ড। ১৯৯৫-এ মণিরত্নম নির্মাণ করলেন ‘বম্বে (Bombay)’ চলচ্চিত্রটি। এক মুসলমান মেয়ের সঙ্গে এক হিন্দু উচ্চবর্ণীয় যুবকের প্রেম। সমুদ্রতীরের এক পুরনো কেল্লায় বিরহের তরঙ্গ যখন ফুঁসে উঠছে, তখন বোরকাধারী সেই মেয়ে আসে। কাঁটায় আটকে যায় তার বোরকা। সেই বন্ধন খুলে ফেলে সে এগিয়ে যায় ‘প্রেম’ নামক এক শাশ্বতের দিকে। পর্দা কাঁপছে তখন এআর রহমানের প্রতিভাধরের সুর সৃজনে। ‘তু হি রে... তেরে বিনা ম্যাঁয় ক্যায়সে জিউঁ’। সেই দৃশ্য নিয়ে আপত্তি উঠেছিল কোনো কোনো মহল থেকে। কিন্তু ধোপে টেকেনি সে সব।

১৯৭৭-এ ‘অমর আকবর অ্যান্টনি (Amar Akbar Anthony)’-তে ‘পর্দানশিঁ’-কে বে-পর্দা করার পেছনে কী দায় ছিল জরুরি অবস্থার পরে এক নতুন ভারত গড়ার জন্য মেদুর আবেদনের? আর ‘বম্বে’ কি সেই আবেদনের অসারত্বকেই তুলে ধরেছিল ১৯৯৫-এর স্বপ্নভঙ্গের দিনগুলোতে? এখন ‘পর্দা’ এক ঘোরতর রাজনৈতিক উচ্চারণ। পক্ষে-বিপক্ষে চাপানউতর। পড়লে ‘গেল গেল’ বলে উঠবেন প্রগতিবাদীরা, না পড়লে গোসসা হবে রক্ষণশীলদের। এর মধ্যে কি কোথাও স্বস্তি নেই?

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক