ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কিউলেক্স, এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয় ও টস্কোরিনকাইটিস অন্যতম।

শীত পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে বসন্তে সারা বাংলাদেশে মশার উপদ্রব বাড়ে। এই সময়ে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মশা অনেক বেশি হয়।

বর্তমান সময়ে যে মশাগুলো রয়েছে তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ কিউলেক্স মশা। মার্চ মাসে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছানোর কথা আমি ফেব্রুয়ারিতে বলেছি। সম্প্রতি উত্তরায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় গিয়েছি, সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে কিউলেক্স মশা এবং এর লার্ভা পেয়েছি।

কিউলেক্স মশা বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ ছড়ানোর প্রমাণ থাকলেও ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশের এলাকায় এ রোগটির সংক্রমণ আমরা কখনোই পাইনি। কারণ ফাইলেরিয়া রোগটি ডেঙ্গু রোগের মতো নয়।

শীত পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে বসন্তে সারা বাংলাদেশে মশার উপদ্রব বাড়ে। এই সময়ে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মশা অনেক বেশি হয়।

ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী একটি এডিস মশা যেকোনো সুস্থ মানুষকে একবার কামড়ালে তার ডেঙ্গু হতে পারে কিন্তু ফাইলেরিয়া জীবাণু বহনকারী একটি মশা একবার কামড়ালে তার ফাইলেরিয়া নাও হতে পারে। এজন্য ফাইলেরিয়ার সংক্রমণ হার কম হয়। সরকার অনেক বছর ধরে ফাইলেরিয়া নির্মূলে বিনামূল্যে কৃমির ওষুধ বিতরণ করছে যে কারণে ফাইলেরিয়া এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

কিউলেক্স প্রজাতির মশা ড্রেন, ডোবা, নর্দমা এবং পচা পানিতে হয়। অনেকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণেই ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি ঘন হয়ে গেছে এবং পানিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এই জৈব উপাদান মশার লার্ভার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমান সময়ে পানিতে পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে। অন্যদিকে শীত পরবর্তী সময়ে উপযোগী তাপমাত্রা মশার বৃদ্ধি এবং প্রজনন ত্বরান্বিত করেছে এবং এই সময়ে মশা পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম পাড়ে। এসব কারণেই বর্তমান সময়ে মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি।

রাজধানীর চারদিকে নিম্নাঞ্চলগুলোতে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় ঝিল, ডোবা, নালার পরিমাণ বেশি। এসব নিচু জমিতে ঢাকার পানিগুলো জমে। এই ডোবা-নালা, ঝিলগুলো এখন কচুরিপানা এবং ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকার কারণে এসব জায়গায় মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে।

কিউলেক্স মশা প্রায় দুই কিলোমিটার উড়ে রক্ত খাওয়ার জন্য আসতে পারে। দুই কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো জায়গায় ডোবা, নর্দমা, ড্রেন, বিল, ঝিল থাকলে সেখানে এই মশার ঘনত্ব পাওয়া যাবে।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে বর্ষাকালে এবং তার পরবর্তী সময়ে। শীতকালে এডিস মশার ঘনত্ব কম থাকে, তবে একেবারেই নেই তা নয়। বর্তমান সময়েও হাসপাতালে প্রতিদিন এক, দুইজন করে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে এই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিউলেক্স প্রজাতির মশা ড্রেন, ডোবা, নর্দমা এবং পচা পানিতে হয়। অনেকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণেই ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি ঘন হয়ে গেছে এবং পানিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এই জৈব উপাদান মশার লার্ভার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পূর্বে এডিস মশার প্রজনন পাত্র অপসারণের একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম এবং জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পরিকল্পনা এখনই করা প্রয়োজন।

মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে কমিটি গঠন করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনাকে কিউলেক্স মশা এবং এডিস মশার জন্য আলাদা আলাদাভাবে সারাবছর ব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে পরিচালিত করতে হবে।

মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পূর্বেই মশার প্রজনন স্থানগুলোতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টসাধ্য।

যেকোনো কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে। তবে সম্পূর্ণ দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপর না চাপিয়ে আমরা সকলে যদি যার যার অবস্থান থেকে সম্পৃক্ত হই তখনই এই কাজটি সহজ হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের (ঢাকার ক্ষেত্রে, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন) পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। মশার প্রজনন স্থান আমরা নাগরিকরা তৈরি করি। আমরা যদি সচেতন হই, ময়লা আবর্জনা সঠিক স্থানে ফেলি, আমাদের পাড়া-মহল্লার অপরিষ্কার জায়গাগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলেই মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া সম্ভব। সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে এ কাজটি করা বেশ কঠিন। 

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com