ছবি : সংগৃহীত

সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের জন্য করোনার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। টিসিবির ট্রাক সেল এখন সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সারি দেখলেই অনুমেয়।

বিগত দুই বছর মানুষ করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। সেই ধকল সামাল দিতে গিয়ে সীমিত ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জীবন এমনিতে চরম সঙ্কটে। দেশের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ বাধ্য হয়ে চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোতে ব্যয় কমিয়ে ফেলেছে।

সাধারণ মানুষের অভিমত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও টিকা নিয়ে হয়তো করোনাভাইরাস ঠেকানো সম্ভব, কিন্তু নিত্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধিতে রীতিমতো অসহায় সর্বস্তরের মানুষ। খোদ বাণিজ্য মন্ত্রীও বলেছেন, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের করণীয় কিছু নেই। মানুষকে আয়ের বড় অংশই খরচ করতে হচ্ছে বাসা ভাড়া ও নিত্যপণ্যের বাজারের পেছনে। আবার অনেকেই বাড়তি ব্যয় মেটাতে তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসা নিচ্ছেন।

অনেক সন্তানের পড়ালেখাতেও ছেদ পড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। করোনায় দেশে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায় রাখতে না পারলে দরিদ্র মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।

নিত্যপণ্যের বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। সীমিত ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় পরিবারের খাদ্যের জোগান দিতে। আর এই খাদ্যের বড় অংশই চাল। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও তাদের ঘাড়ে চাপে বেশি।

মানুষকে আয়ের বড় অংশই খরচ করতে হচ্ছে বাসা ভাড়া ও নিত্যপণ্যের বাজারের পেছনে। আবার অনেকেই বাড়তি ব্যয় মেটাতে তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসা নিচ্ছেন।

নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আয়ের সাথে ব্যয় মেলাতে না পেরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এখন কম দামে পণ্য পেতে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১০১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয়।

শুক্রবার বাদে সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়। একজন ক্রেতা সয়াবিন তেল দুই লিটার, চিনি ও মসুর ডাল দুই কেজি এবং পেঁয়াজ সর্বনিম্ন দুই কেজি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি কিনতে পারেন। লাইনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত সবাই পণ্য পান না। দুই-তিন ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরও কেউ কেউ ফিরে যান খালি হাতে।

বর্তমানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত তেল ১৬৮ টাকা। পেঁয়াজের কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, চিনি ৮০ থেকে ৮২ এবং বড় দানার মসুর ডাল ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে ক্রেতা বাজার থেকে এসব পণ্য না কিনে টিসিবির ট্রাক থেকে কিনলে তার সাশ্রয় হয় ২৩৬ থেকে ২৬০ টাকা। বাড়তি এই টাকা সাশ্রয় করার জন্য প্রতিদিনই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনার ঝড় তুলেছে টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন, কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় প্রতিযোগিতার দৃশ্য। যদিও দুই সপ্তাহ আগেই সরকার ঘোষণা করলো, দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির চাপে প্রকৃত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মানুষের আয়ের আসল চিত্র। যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তাহলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য মূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না? নাকি নিমিষেই আয় কমে গিয়ে আমরা দরিদ্র হয়ে গেলাম?

বাণিজ্য মন্ত্রীও বললেন, টিসিবির ট্রাকের লাইনে ভালো পোশাক পরে মধ্যবিত্ত লোকজনও দাঁড়াচ্ছেন। এই যে ‘ভালো পোশাক’ পরেও মানুষ টিসিবির গাড়ির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, তার কারণ কী? যতক্ষণ তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ তার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? বিষয়টি কি সরকারের কেউ ভেবে দেখেছেন? টিসিবির ট্রাকের এই দীর্ঘ সারি বলে দিচ্ছে, যারা দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছেন, তাদের পাশাপাশি স্বল্প, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অনেকে এখন সেই সারিতে দাঁড়াচ্ছেন। এই চিত্রই বলে দিচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমেছে। অনেকে লজ্জায় এই লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না। 

নিত্যপণ্যের বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অবদান কম নয়, অতিদরিদ্র কমানোর ক্ষেত্রেও অবদান রয়েছে। তবে সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপণ্যের মূল্যকে মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান কি আমরা দেখেছি? এখনো কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য মূল্যের বিস্তর ফারাক। একদিকে কৃষকদের অভিযোগ, তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ভোক্তারা উচ্চ দামের কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন।

ব্যবসায়ীরা আবার বলছেন, রাস্তায় চাঁদাবাজির কারণে দামের এ বিস্তর পার্থক্য সিন্ডিকেটের জন্য নয়। পণ্য পরিবহনে পদে পদে উচ্চ হারে চাঁদা দিতে হয়, সেটি কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে কখনো সরকারদলীয় লোকজনকে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে। যতই ভালো কিছুই করবে, সাধারণ মানুষ তার সুফল পাবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ‘পাগলা ঘোড়া'র সঙ্গে দৌড়াতে গিয়ে হাঁপাচ্ছেন প্রান্তিক মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও। ফলে টিসিবি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে মানুষ ছুটছে টিসিবির ট্রাকের পিছু পিছু। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মলিন মুখ। যাদের সিংহভাগই আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দেখা যায়, যে পরিমাণ পণ্য নিয়ে টিসিবির ট্রাক আসে, তা দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ফলে যারা ভোর থেকে লাইনে দাঁড়ান, তাদের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ পণ্য কিনতে পারেন না।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত হু হু করে বাড়তে থাকায় সর্বস্তরের মানুষ টিসিবির ট্রাকমুখী হচ্ছে। সরকার টিসিবির পণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। রমজানে ১ কোটি লোককে পণ্য বিক্রির আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন সরকার। তবে এ উদ্যোগ স্বল্প পরিসরে ক্রেতাকে স্বস্তি দিলেও এটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়।

টিসিবির সারি ছোট করতে হলে বাজারে পণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। চট্টগ্রাম কাস্টমস, বন্দর ও আমদানিকারকদের দেওয়া তথ্য মতে, রমজানে ব্যবহার্য নিত্যপণ্যের আমদানি ও মজুত পর্যাপ্ত আছে। তারপরও প্রতিদিন দাম বাড়ছে। আর বাজা/রে আমদানি ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে ব্যাপক ফারাক দেখা যায়।

প্রায়শ দেখা যায়, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও মৌসুমী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্য মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু বাজারে সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষকে দেখা যায় না, এই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। ফলে ব্যবসায়ীরাই ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন এবং যখন গণমাধ্যমকর্মীরা জিজ্ঞেস করেন তারা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে থাকেন।

বাণিজ্য মন্ত্রীও বললেন, টিসিবির ট্রাকের লাইনে ভালো পোশাক পরে মধ্যবিত্ত লোকজনও দাঁড়াচ্ছেন। এই যে ‘ভালো পোশাক’ পরেও মানুষ টিসিবির গাড়ির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, তার কারণ কী? যতক্ষণ তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ তার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? বিষয়টি কি সরকারের কেউ ভেবে দেখেছেন?

দেশীয় উৎপাদিত ও আমদানিকৃত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ বা বিপণন সব পর্যায়ে চাঁদাবাজদের আগ্রাসন ছাড়াও নানাবিধ কারণে রয়েছে। এসব কারণে পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু সেই বাড়তি দামটি মূলত ভোক্তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে।

চাঁদাবাজি ও অতিরিক্ত পরিবহন খরচের ক্ষেত্রে সরকারকে জিরো টলারেন্সে প্রদর্শন করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এছাড়া উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া, সরকারি পর্যায়ে মজুত বাড়ানো, সময়মতো আমদানি করলে বাজারে এক ধরনের সবুজ সংকেত যায়। ফলে পণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাশাপাশি যারা অবৈধ উপায়ে বাজারে প্রভাব বিস্তার করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এছাড়াও বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বিঘ্নকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় করতে পারেন। আবার অত্যাবশ্যকীয় আমদানিকৃত পণ্যের অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক, কর, ভ্যাট সংকটকালীন সময়ে হ্রাস করে অস্থিরতাকে কিছুটা থামানো যেতে পারে। তাই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে।

ব্যাপকহারে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দিয়ে তাদের আয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। এছাড়াও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে আমদানি, পাইকারি, পরিবেশক ও খুচরা পর্যায়ে বাজার তদারকি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থাপনায় চাল, আটা, চিনি, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্য প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি, বিশেষ করে করোনাকালে যাদের আয় কমে গেছে, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। 

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com