ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ বলে কথা নয়। উন্নত বিশ্বেও উৎসব হয়। তখন মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করে। সব ধরনের পরিবহনে অস্বাভাবিক চাপ বাড়ে। তাই উৎসবকেন্দ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অভিভাবক প্রতিষ্ঠান থাকে, যারা বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজটি করে। কোন মাধ্যমে কত লোক যাতায়াত করবে, সেটা জানা না থাকলে তারা এই কাজটি ভালোভাবে করতে পারত না।

আমরা যেহেতু তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সিদ্ধান্ত নিই, তাই ব্যবস্থাপনা ঠিক হয় না। ফলাফল হলো সব পথেই ভোগান্তি মাথায় নিয়ে নাড়ির টানে বাড়ি যেতে হয় ঘরমুখো মানুষের। প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছর ধরে দেশে ঈদ উৎসব হয়ে আসছে। কিন্তু উৎসবে কোনো পথেই নিরাপদ ও ভোগান্তিহীন যাত্রা নিশ্চিত করা গেল না! এরচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে?

এক কথায় যদি বলি, নৌ-সড়ক-রেল থেকে শুরু করে আকাশ পথ পর্যন্ত কোন রুটে কেমন যাত্রী হতে পারে এ সংক্রান্ত কোনো ধারণা নেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর। একারণে গণপরিবহন বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যা আছে তা দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দায়সারা চেষ্টা দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো, ঈদ উৎসবের তিনদিন আগে থেকে সবকিছু একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়! যা কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়।

ঘরমুখো মানুষ নানা নৈরাজ্য আর ভোগান্তির শিকার হলেও তা সমাধানের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। ঈদের আগে কথিত ভিজিলেন্স টিম এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যায়। এরকম বাস্তবতায় দায়সারা ঈদ ব্যবস্থাপনা জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে যুগের পর যুগ!

একদিকে তো গণপরিবহন সংকট অন্যদিকে সড়কপথে যানজটের দুর্দশা। স্বল্প গতির যানবাহন বা নিষিদ্ধ যান উন্নত দেশের কোনো মহাসড়কে না চললেও আমাদের দেশে অহরহ চলে! কারণ মহাসড়কে এসব যান চলাচলে পৃথক সার্ভিস লেন নেই।

অর্থাৎ পরিকল্পনায় গলদ! আরেকটি বড় সমস্যা হলো, নিয়ম অমান্য করে যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়। নগরীর পরিবহনগুলো ঈদের তিনদিন আগে থেকে দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে যাতায়াত শুরু করে। লক্কর ঝক্কর মেয়াদ উত্তীর্ণ সর্বনাশা বাসগুলো বাড়তি আয়ের আশায় বিনা বাধায় চলে!  

উন্নত দেশে কোনো চালকের একটানা ছয় ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। আমাদের দেশে টানা ১২-১৮ ঘণ্টাও কখনো চালকেরা গাড়ি চালান। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা কমবে, এই আশা আমরা করি কীভাবে?

ঈদে যানবাহনের কয়েকগুণ বেশি চাপ থাকলেও মহাসড়কের পাশে বাজার, অবৈধ দোকানপাট, টার্মিনাল সবই থাকে আগের মতো! বাস বাড়ানোর উদ্যোগ নেই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। এই অবস্থায় সড়কপথে শান্তিতে ঘরে ফেরা যাবে না এটাই স্বাভাবিক।

যাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারানো রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি ঈদ সার্ভিস চালু করলেও এতে ঘরমুখো মানুষের সাড়া মিলে না। রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের প্রবেশদ্বারগুলোতে অসহনীয় যানজটে পড়তে হয়। এই সমস্যার সমাধান ইচ্ছা করলেই সম্ভব। এতেও আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। 

দূরপাল্লার যাত্রায় দুজন চালক ছাড়া গাড়ি চলার অনুমতি ইউরোপের দেশগুলোতে নেই। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার মতো দেশেও একই চিত্র। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গেও একই নিয়ম করা হয়েছে। উন্নত দেশে কোনো চালকের একটানা ছয় ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। আমাদের দেশে টানা ১২-১৮ ঘণ্টাও কখনো চালকেরা গাড়ি চালান। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা কমবে, এই আশা আমরা করি কীভাবে?

ঈদেও বাড়তি চালকের জোগান দিতে ব্যর্থ সব পক্ষই। নতুন সড়ক আইনে দূরপাল্লার বাসে দুইজন চালকের কথা উল্লেখ থাকলেও এটি ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ এরকম অবস্থায় ঠেকেছে।

বিআরটিএ-র তথ্যমতে, সব মিলিয়ে ২০ ধরনের ৫১ লাখের বেশি নিবন্ধিত সড়কযানের বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২৮ লাখ। অর্থাৎ নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে প্রায় ৩৩ লাখ চালক সংকট। তাহলে কি অন্য গাড়িগুলো বসে আছে? এত সংখ্যক অবৈধ চালক রাস্তায় ছুটে বেড়ালে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা আদৌ সম্ভব?

নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে বাস, মিনিবাস মিলে প্রায় ৮০ হাজার। এরমধ্যে দেখা যাবে একটা বড় অংশ নষ্ট। এই কটা বাস দিয়ে কি সড়কপথে ঈদ পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব? অথচ সড়কে গণপরিবহন নিয়ে একটি বিশদ পরিকল্পনা আগে থেকেই করা যেত।

ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটির বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে, বলছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এক জেলা থেকে অপর জেলায় প্রায় ৫ কোটি মানুষ যাতায়াত করতে পারে। যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে ঈদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হয়েছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঈদের আগের চার দিন প্রতিদিন ৩০ লক্ষ মানুষ ঢাকা ছাড়বে। কিন্তু সড়ক-রেল ও নৌপথে যাত্রী পারাপারের সক্ষমতা আছে ১৩ থেকে ১৪ লাখ। বাকি ১৬ লাখ মানুষ কি তাহলে বাড়ি যাবে না? অবশ্যই যাবে।  তারা ছোট যানবাহন, ট্রেনের ছাদে, ট্রাকে, মোটরসাইকেলে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্নভাবে যাতায়াত করবে।

সবচেয়ে নিরাপদ বাহন রেল। ট্রেন সংখ্যা কম হাওয়ায় রেলপথ ব্যবহার সবার ভাগ্যে জোটে না। উৎসবকেন্দ্রিক একদিকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটার ভোগান্তি চলছে যুগের পর যুগ।

এতে সড়ক ব্যবস্থাপনা কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পুলিশ-শ্রমিক-মালিক-বিআরটিএ মিলে সড়কে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দেখি না। এবারও যাত্রীর চাপ দ্বিগুণ থাকায় সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনার সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা কেউ বলতে পারে না!

গুরুত্বপূর্ণ ঘাটে ফেরি সংকট, নাব্যতা কম থাকায় ভোগান্তি নিয়মিত চিত্র। যানবাহনের বাড়তি চাপে ঘাটগুলোতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। এমনও নজির আছে ফেরি ঘাটেই ঈদ করতে হয়েছে ঘরমুখো মানুষদের।

সদরঘাট থেকে প্রায় সবগুলো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে। এসব নৌযানে জীবনরক্ষা সরঞ্জামগুলো আছে কি না তা পরীক্ষা পর্যন্ত করা হয় না। জোড়াতালি লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চগুলোও যাত্রী টানায় লেগে যায়। বছরের পর বছর এমন দৃশ্যে অভ্যস্ত হলে প্রতিকার কেন নেই? এসব সমাধানে বিশদ পরিকল্পনা বা অর্থায়নের দরকার হয় না।

ঈদযাত্রায় ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ এ তিন জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ নৌপথে উপকূলীয় জেলাগুলোতে যাবে। কিন্তু মাত্র ১২ দিনে একমুখী এত যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌযান নেই। ফলে লঞ্চের ডেকে অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি ছাদেও যাত্রী বহন করা হবে এবং এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই ঈদে বিড়ম্বনামুক্ত নিরাপদ নৌযাত্রার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত হলেও তা আদৌ কি সম্ভব?

অভ্যন্তরীণ বিমানে যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। বেশি যাত্রী চাপ সামলানোর ব্যবস্থা এপথেও নেই। তেমনি যাত্রীদের বিমানে উৎসবকেন্দ্রিক বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। এ নিয়ে কেউ কিছু বলে না।

সবচেয়ে নিরাপদ বাহন রেল। ট্রেন সংখ্যা কম হাওয়ায় রেলপথ ব্যবহার সবার ভাগ্যে জোটে না। উৎসবকেন্দ্রিক একদিকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটার ভোগান্তি চলছে যুগের পর যুগ। ৫০ ঘন্টা আগে লাইনে দাঁড়িয়েও মানুষ কাঙ্ক্ষিত টিকিট পান না।

এমন ভোগান্তি কি নিরসন করা যায় না? অবশ্যই সম্ভব। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো গবেষণা নেই। তেমনি ঈদযাত্রা শুরু হলে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ওঠার প্রবণতা আছেই। প্রয়োজনীয় ট্রেন সংখ্যাও বাড়ানোর সক্ষমতা নেই রেল বিভাগের।

সব মিলিয়ে যদি বলি, ঈদযাত্রায় কোনো পথেই সুখকর সংবাদ নেই। নেই সঠিক ব্যবস্থাপনা। এই অবস্থা থেকে কবে মানুষের মুক্তি মিলবে জানি না?

আগে ঈদ উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সব ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো। গত কয়েক বছর তাও আর হচ্ছে না। উৎসবকেন্দ্রিক অভিভাবক প্রতিষ্ঠান গঠনেরও কোনো চিন্তা নেই। যার যে মন্ত্রণালয়, তারা সেভাবে ঈদের প্রস্তুতি নেয়। রাষ্ট্র কবে দুর্দশামুক্ত উৎসবের যাত্রা নিশ্চিত করতে পারবে? সে অপেক্ষায় রইলাম।

রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক