ছবি : সংগৃহীত

কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। কারখানা দুর্ঘটনায় এক পা হারানো জীবন্ত নারী শ্রমিকের। মনুষ্য পায়ের পাতার পাশাপাশি তার কাঠের পায়ের পাতাতেও নখ রঞ্জনী বা নেইল পলিশ লাগানো ও মল পরা। এই ছবি দেখে দুই চোখের অশ্রু ধরে রাখা কঠিন।

ছবিটি দেখে মনে পড়ে গেল, কয়েক বছর আগে সাভারের সেই বিভীষিকা জাগানো পোশাক কারখানা দুর্ঘটনার পর (একক দুর্ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক যে ঘটনায় হতাহত হয়েছেন) অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে ছুটে যাওয়া এবং পাশ্ববর্তী যে হাসপাতালে আহত শ্রমিকদের শুশ্রূষা চলছিল সেখানে যাওয়া।

সাভারের সেই এনাম হাসপাতালে ঢুকেই রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে হাত-পা কর্তিত হয়েছে এমন নারী শ্রমিকদের কোথায় সর্বোচ্চ সংখ্যায় পাওয়া যাবে। উত্তরে আমাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে ওয়ার্ডটিতে যেতে বলেছিলেন, আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে (সাংবাদিকতা-উন্নয়ন কাজ-ব্যক্তি উদ্যোগে এ্যাক্টিভিজম বা নিছক লেখক হিসেবে ঘোরাঘুরি) এমন মর্মন্তুদ কোনো দৃশ্য তার আগে বা পরে আমি দেখিনি।

একটি ওয়ার্ডে প্রায় জনা বারো নারী যাদের কারো দু’হাত, দু’পা, একটি হাত ও একটি পা ভেঙে পড়া কারখানা গৃহের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করার সময় করাত দিয়ে কেটে ফেলতে হয়েছে। বাঁচার আশায় অন্ধকার সেই মরণকূপে আটক শ্রমিকেরা উদ্ধারকর্মীদের নিজেরাই বলেছেন, দয়া করে তাদের একটি হাত বা পা কেটে হলেও উদ্ধার করতে।

ভাবা যায়, বাঁচার আকাঙ্ক্ষা কতটা তীব্র হতে পারে মানুষের? এক নারী শ্রমিক নিজেই উদ্ধারকর্তাদের কাছ থেকে করাত চেয়ে নিজের দু’পা নিজেই কেটে ফেলেছিলেন দুরূহ জীবনতৃষায়। বলেছিলেন, ‘দুই পা কাটার পর দেখি রক্ত আর থামছে না।’

...গার্মেন্টসে প্রায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের কেউই চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের বেতন পাননি। সব বকেয়া ও ঈদ বোনাস ২০ এপ্রিল দেওয়ার কথা ছিল। তবে মালিকপক্ষ টাকা দেয়নি। গার্মেন্টস মালিকও কারখানায় আসছেন না ২ সপ্তাহ ধরে।

সুনামগঞ্জের ১৭/১৮ বছরের এক হাত ও এক পা কর্তিত মেয়ে শ্রমিকের জন্য কমলালেবু এনেছিল তার জ্যেঠতুতো দাদা। রংপুরের এক নারী শ্রমিক কাঁদছিলেন যে, তার এক হাত ও এক পা যাওয়া এই কবন্ধ রূপকে ক’দিন পরেই জীবনসঙ্গী নিশ্চিত তালাক দেবে। জীবনসঙ্গী যুবক অবশ্য তখনো পর্যন্ত পাশে বসেছিল পরম মমতায়। তারপর এতদিনে কী হয়েছে সেটা তো আর জানি না।

নিতান্ত বারো থেকে সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছর বয়সের বালিকাকে দেখেছিলাম যার দু’টো হাতই কাটা গেছে। তার রিকশাচালক বাবা তার জন্য টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এনেছিল। সাদা একটি ফ্রক পরা, দু’টো কলা বেনী করা সেই কিশোরীর চোখে-মুখে তখনো শৈশবের সারল্য মোছেনি। ঐ কিশোরী শ্রমিকের মুখ মনে পড়লে আজও ঠিক কেমন যে লাগে সেটা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

এই পোশাক শ্রমিকদের ভেতর বিএ পরীক্ষা দেওয়া একজন নারীও ছিলেন। তিনি ঠিক শ্রমিক নন তবে শ্রমিক নারীদের ফার্স্ট এইড দিতেন। তার বরও এই কারখানায় কাজ করতেন। পরিবারের অমতে বিয়ে করে এই প্রেমিক দম্পতি সাভারে এসে বাসা বেঁধেছিলেন ও দু’জনেই কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন।

দুর্ঘটনার সময় তার বর এমএ পরীক্ষা দিতে রংপুর গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে কান্নাকাটি কিছুই না করে সবকিছু বেশ দৃঢ়ভাবে সহ্য করছিল। তার বর তখনো রংপুর থেকে এসে পৌঁছায়নি। মেয়েটির সম্ভবত একটি হাত কাটা গিয়েছিল।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে দেখেছিলাম এক বাবা-মা’কে যারা তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ের ছবি হাতে ঘুরছিলেন। মেয়ে যে আর বেঁচে নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তারা বিলাপ করছিলেন যে অন্তত মেয়েটির হাড়গুলো পেলেও দেশের বাড়ি নিয়ে কবর দেবেন। দুঃসহ স্মৃতির এই রোমন্থনের বদলে বরং বাস্তবে ফিরে আসি। 

ঢাকা পোস্ট-এর ২৫ এপ্রিলের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, গতকাল দুপুর দেড়টা পর্যন্ত উত্তরা ও মিরপুরে শ্রমিকদের অবরোধ চলছিল। রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরার জসীমউদ্দীন-আজমপুর সড়ক অবরোধ করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকেরা। ঈদের আগে বকেয়া বেতন ও বোনাস না পেয়ে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন তারা।

জানা গেছে, সোমবার দুপুরের দিকে মিরপুর ১১ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন কটন টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকেরা। আর উত্তরায় অবস্থান নেন ইন্ট্রাকো ডিজাইন লিমিটেড এবং ইন্ট্রাকো ফ্যাশন লিমিটেড নামে দুইটি গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা। উত্তরার দুটি গার্মেন্টসের মালিক একই ব্যক্তি।

মিরপুরের শ্রমিকেরা জানান, এ গার্মেন্টসে প্রায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের কেউই চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের বেতন পাননি। সব বকেয়া ও ঈদ বোনাস ২০ এপ্রিল দেওয়ার কথা ছিল। তবে মালিকপক্ষ টাকা দেয়নি। গার্মেন্টস মালিকও কারখানায় আসছেন না ২ সপ্তাহ ধরে। এ অবস্থায় রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না।

কটন টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিক বোরহান উদ্দিন বলেন, গত ২৩ এপ্রিল একই দাবিতে সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল। মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছিল পুলিশ। তবে দুই দিন ধরে তারা আর যোগাযোগ করেনি।

...২৩ এপ্রিল একই দাবিতে সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল। মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছিল পুলিশ। তবে দুই দিন ধরে তারা আর যোগাযোগ করেনি।

এদিকে ইন্ট্রাকো ডিজাইন লিমিটেড এবং ইন্ট্রাকো ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকেরা বলেন, তাদের গার্মেন্টস দুইটি একই মালিকের। তাদের কারও ২ মাসের বেতন বকেয়া, কারও ৩ মাসের বেতন, ওভারটাইম ও বোনাস পাওনা। দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা।

২৬ এপ্রিল দৈনিক বণিক বার্তা-য় প্রকাশিত আর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, এপ্রিলের ২৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো উৎসব ভাতা পরিশোধ করেনি ৬৫ শতাংশের বেশি কারখানা, সংখ্যার হিসাবে যা ৬ হাজার ২৫। এলাকাগুলোর কল-কারখানায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকিতে নিয়োজিত শিল্প পুলিশ বলছে, সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সহায়তা নিয়ে সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা হচ্ছে। যদিও সম্প্রতি সরকার-মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ঈদের আগে এপ্রিলের ১৫ দিনের বেতনসহ ঈদ বোনাস পরিশোধ করতে হবে। ঈদের আগে বরাবরই অস্থিরতা বিরাজ করে দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকার কারখানাগুলোয়।

শিল্প পুলিশের পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে এমন কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ১৫১, শতকরা হিসাবে যা দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে আশুলিয়ায় ৪৩৩টি, গাজীপুরে ৮৭৬, চট্টগ্রামে ৫৮৮, নারায়ণগঞ্জে ৩১০, ময়মনসিংহে ১৬৯, খুলনায় ১৮১ ও সিলেটে ৫৯৪টি শিল্প-কারখানা ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে।

দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ এটাই যে, বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে এত চর্চা, এত মসজিদ-মাদরাসা, কথায় কথায় ৫৭ ধারার ধুয়ায় যখন তখন যাকে খুশি গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা, অথচ শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সেই কত আগে হাদিসে বলে যাওয়া বাণী যে, ‘মজুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো’- ধর্মের এই মর্মবাণী কে আর কবে কোথায় মেনেছে?

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরা ম্যানচেস্টারের পোশাক শিল্পকে বিকশিত করার লক্ষ্যে সুকৌশলে ও পরিকল্পিতভাবে ঢাকাসহ গোটা পূর্ববঙ্গের মসলিন তথা তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং তাঁতিরা একরকম কাঠামোগত মৃত্যু বা বলা চলে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। সে না হয় সাদা প্রভুরা আমাদের সাথে করেছিল। আজ বাদামি মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্রে বাদামি প্রভুরাই কীভাবে স্ব-বর্ণের শ্রমিকদের হত্যা করছে তার কি কোনো ক্ষয়-খতিয়ান আমরা আদৌ নথিবদ্ধ করছি?

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক