ছবি : সংগৃহীত

ক্যাবসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম যখন নিত্যপণ্যের বাজারে প্রতারণা ও অতি মুনাফার কথা বলছে, তখন কিছু কিছু ব্যবসায়ী নেতারা তা স্বীকার করতে চায়নি। তাদের যুক্তির শেষ নেই। অধিকন্তু সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও ব্যবসায়ীদের বক্তব্যকে সমর্থন করা হচ্ছিল। চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসলার কারসাজির পর কাপড়ের দোকান, সর্বশেষ বাস কাউন্টারগুলোতে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের পর হাতেনাতে ধরা পড়ল।

প্রতারণা, কারসাজি, অতি মুনাফা করে ভোক্তার পকেট কাটার উৎসব। এখন সে কারণে আমরা দেখছি অনেকে বলা শুরু করছে, ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে। যদিও এর আগে কিছু লোকজন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নিয়ে নানা সমালোচনায় মুখর ছিলেন।

রমজানের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জন্য মূল্য ছাড় দেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় বড়দিন উপলক্ষে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে পূজার সময় মূল্য ছাড় দেওয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে মূল্য না কমিয়ে ভিন্ন মাত্রায় প্রতারণরা করে অতি মুনাফা লাভে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

হোটেল, রেস্তোরাঁয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ইফতারি তৈরি ও বিক্রি, বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে সেমাই, ঘি তৈরি, বেশি দামে মাংস ও বাসের টিকিট বিক্রির মতো অনৈতিক কাজে বেপরোয়া ব্যবসায়ীরা। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত জুতার কোম্পানি বাটা, দেশীয় অ্যাপেক্স জুতায় নতুন সিল মেরে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে।

একইভাবে খাদ্য, জামাকাপড়, প্রসাধনী থেকে শুরু করে গণপরিবহনে বাসভাড়ার ক্ষেত্রেও ভোক্তাদের ঠকাতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা ঠেকাতে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনের বাজার অভিযান পরিচালনা করছে।

অপরাধের জন্য আদায় করা হচ্ছে জরিমানা, করা হচ্ছে সতর্ক। কিন্তু তারপরও তাদের অপতৎপরতা থামছে না। ২০ এপ্রিল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর কদমতলী থানার জুরাইন-পোস্তগোলা এলাকার আলম সুপার মার্কেটে আব্দুস সাত্তার সুজ নামের কারখানায় বাটা, অ্যাপেক্সসহ নামীদামি ব্র্যান্ডের লোগোর আদলে নকল লোগো দিয়ে স্যান্ডেল তৈরি করছে।

ইউরোপ ও আমেরিকায় বড়দিন উপলক্ষে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে পূজার সময় মূল্য ছাড় দেওয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে মূল্য না কমিয়ে ভিন্ন মাত্রায় প্রতারণরা করে অতি মুনাফা লাভে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

অ্যাপেক্স  হয়ে গেছে অ্যাডেক্স ও বাটা হয়েছে বালা। এছাড়া অ্যাপেক্সের লোগো হুবহু নকল করা হচ্ছে। কারখানার কোনো ধরনের অনুমোদন ও ট্রেড লাইসেন্সও নেই। একইভাবে রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে দেখা যায় সতেরশ টাকার শাড়ি ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিভিন্ন দোকানে ইচ্ছেমতো স্টিকার দিয়ে দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার কোনো ক্রয়ের রশিদ নেই, বিক্রির রশিদও দেওয়া হয় না। এর বাইরে অভিনব কায়দায় প্রতারণা দেখা যায় নিউমার্কেটের ইরো ইথিক ওয়ার নামে পাঞ্জাবির দোকানে। পাঞ্জাবির প্রকৃত দাম ১ হাজার ১৯০ টাকা।

মূল্য ছাড়ের নামে সেই পাঞ্জাবির দাম লাগানো হয়েছে ২ হাজার ৪৯০ টাকা। এই মূল্যের ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্টিকারের নিচে আরেকটি স্টিকার লাগানো রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ৭৯০ টাকা এবং এর নিচে আরও একটি স্টিকার রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ১৯০ টাকা।

শুধু পোশাকের ব্যবসায়ীরা নয়, ইফতারির আইটেম ও খাদ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্বিধা রোধ করছে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ধানমন্ডির মিরপুর রোডে রস মিষ্টির সৃষ্টি খাদ্য পরিবেশন করতে দেদারসে।

অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা শুধু পণ্যের মূল্য পুনর্নির্ধারণ কিংবা খাদ্যে ভেজালই নয়; প্রতারণা চলছে খাদ্যে রং মিশিয়ে, মরা মাছে গরুর রক্ত মিশিয়ে, মহিষের মাংসকে গরু এবং কুকুরের মাংসকে খাসির মাংস বলে, পুকুরের মাছকে নদীর মাছ বলে। প্রতারণা আছে পোড়া মবিল দিয়ে ভাজাপোড়া করা, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বেচাকেনা করা, রডের পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চি এবং সিমেন্টের স্থলে বালি ব্যবহার করা ইত্যাদি।

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই ব্যবসাও জমজমাট করতে মেতে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অব্যাহত প্রতারণার সঙ্গে নতুন করে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পণ্যের নির্ধারিত মূল্যে ঘষাঘষি করে নতুন মূল্য লিখে দেওয়া। বিভিন্ন উৎসব, বিশেষ করে ঈদ সামনে রেখে পণ্যের মূল্যের হরহামেশা পরিবর্তন করা। একই পণ্যের ওপর একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার পরিবর্তন করে নতুন মূল্য স্টিকার বদলানোর ঘটনা ঘটছে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রাহকদের কষ্টের টাকার এই জলাঞ্জলি, কষ্টের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

অনলাইনে পণ্য সরবরাহ এবং মূল্য পরিশোধের যে ভয়াবহ প্রতারণা আমরা দেখেছি। মূল্য পরিশোধ করার পরও দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পণ্য আসেনি কিংবা যে পণ্য দেওয়ার কথা তা না দিয়ে নিম্নমানের অন্য কিছু পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও কম নয়। আবার কোনো কিছু না দিয়েই টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। এসব হায় হায় ই-কমার্স কোম্পানির কিছু কিছু আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা চিহ্নিত করতে পারলেও ভুক্তভোগী মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। 

শুধু খাবার বা জামা-কাপড়ে অতি মুনাফা ও প্রতারণা নয়, ঈদকে সামনে রেখে গণপরিবহনে যাতায়াতের বাসগুলোও ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করতে দ্বিধাবোধ করছে না। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কল্যাণপুর ও গাবতলীতে এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন বাস কোম্পানির কাউন্টারে অভিযান পরিচালনা করে অনিয়মের জন্য সর্তকতা ও জরিমানা করেছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনায় পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, নির্ধারিত তালিকার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি, নকল পণ্য প্রস্তুত করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তিমূলক জরিমানা করছে। 

একই পণ্যের ওপর একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার পরিবর্তন করে নতুন মূল্য স্টিকার বদলানোর ঘটনা ঘটছে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রাহকদের কষ্টের টাকার এই জলাঞ্জলি, কষ্টের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তারপরও রমজানকে কেন্দ্র করে অনেক মুসলিম দেশে পণ্যের দাম কমিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে রমজান এলেই খাদ্য-পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ে। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাবও ঘটে। আবার অনেকে মনে করেন, রমজানে একমাস ব্যবসা করব ১১ মাস বসে থাকব। যার কারণে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অসাধু ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজিকে আল্লাহর গজব বলে উল্লেখ করেছিলেন।

ইসলাম পণ্য মজুত ও অতি মুনাফাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ধর্মীয় এসব বাণী সত্ত্বেও কে শুনে কার কথা। রমজানে রোজা রেখেও অনেক ব্যবসায়ী মূল্য কারসাজি, মজুতদারি, কৃত্রিম পণ্য সরবরাহ সংকট তৈরিতে বিরত থাকছে না। বাজারমূল্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রতিটি পণ্যের ক্রয় এবং বিক্রয় মূল্যের চার্ট ঝুলিয়ে রাখার জন্য ভোক্তা সংরক্ষণ আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনেকেই মানছেন না। 

অসাধু ব্যবসায়ীদের ভিত এতই শক্তিশালী যে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র মনে হয় তাদের কাছে অসহায়। টাকা ও ক্ষমতার জোরে সরকারি প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। বরং এরকম জলজ্যান্ত মানুষ মেরে কোটিপতি হওয়ার লোকের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

ইতিপূর্বে একই কায়দায় গুড়াদুধে ময়দা মিশ্রিত করার হোতাসহ চিনি, সয়াবিন, চাল কেলেঙ্কারি হোতাদের কোনো শাস্তি হয়নি। তারা পর্দার আড়ালে আবার রেহাই পেয়ে যায়। আর সাধারণ ভোক্তা হিসেবে জনগণ অসচেতন ও অসংগঠিত, ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভোক্তা সংগঠনগুলোকে সরকারি অবজ্ঞার কারণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে ভেজাল, নিম্নমানের খাদ্যের বাজার ও পরীক্ষাগারে পরিণত করেছেন। ফলে মানুষ যা আয় করছে তার সিংহভাগই ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ জোগাতে চলে যাচ্ছে।

সরকার ও বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলো ব্যবসায়ী ও চেম্বারগুলোকে নানা সুবিধা দিলেও ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দেশে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যা ব্যবসায় সুস্থ ধারা বিকাশে বিশাল প্রতিবন্ধক। 

ব্যবসা শুধুমাত্র একটি অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার নয়, এটি উত্তম সেবাও বটে। যার মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী ভোক্তাকে খাদ্য-পণ্য ও সেবা সার্ভিস দিয়ে সেবাও করছেন। পণ্যের মূল্য ঘষামাজা করে অতি মুনাফা আদায়ে সচেষ্ট হওয়াকে ব্যবসা বলা যায় না। এটা প্রতারণা আর এই প্রতারণা ফৌজদারি অপরাধও বটে।

তবে আইন দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সব সময় সম্ভব না ও হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন অতি মুনাফালোভী, প্রতারক, মজুতকারী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সামাজিক ভাবে বয়কট করা। তাহলেই ব্যবসা-বাণিজ্যে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত হবে। 

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)