কে জি মোস্তফা : তোমারে লেগেছে এত যে ভালো
ছবি : সংগৃহীত
৮ মে রাত। জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষের এক বার্তা আসে। বার্তা পেয়ে আমি চমকে গেছি। কে জি মোস্তফা পরলোকগমন করেছেন। এমনিতে প্রেসক্লাবের সদস্যদের কেউ মারা গেলে কর্তৃপক্ষ সবার কাছে একটি কমন বার্তা পাঠায়। কিন্তু সেই বার্তা পড়ে সবসময় আমরা শোকের তীব্রতা ধারণ করতে পারি না।
বাংলাদেশে তিনজন কে জি মোস্তফা আছেন বা ছিলেন। তিনজনই লেখালেখি, সাংবাদিকতা, সৃজনশীল কাজের সাথে জড়িত। তাই একটু বিভ্রান্তি তৈরি হয় কখনো কখনো। তিনজনের নামের বানানে একটু ভিন্নতা আছে। কিন্তু সাধারণভাবে তিনজনই ‘কে জি মোস্তফা’ হিসেবে পরিচিতি।
বিজ্ঞাপন
এই তিনজনের মধ্যে সাংবাদিক হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘কে জি মুস্তফা’ মারা গেছেন ২০১০ সালে। সিরাজগঞ্জের সন্তান কে জি মুস্তফা দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক সংবাদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। নব্বই দশকের শেষদিকে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক মুক্তকণ্ঠ। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা সৈনিক কে জি মুস্তফা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
আরেকজন ‘কে জি মুস্তাফা’ মূলত শিল্পী। বাংলাদেশের প্রথম প্রবর্তিত সাতটি কাগুজে নোট, ৬টি ধাতব মুদ্রা এবং প্রথম ডাকটিকেটের ডিজাইনার তিনি। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস থেকে কমার্শিয়াল আর্টস-এর উপর গ্র্যাজুয়েশন করা কে জি মুস্তাফার বয়স এখন ৮০। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা কে জি মুস্তাফা এখন ঢাকার হাজীপাড়া এলাকায় থাকেন।
বিজ্ঞাপন
অমরত্ব দেওয়ার জন্য একটি গানই যথেষ্ট। মাহমুদুন্নবীর গাওয়া 'আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে...' গানটিই তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট হতে পারতো...
তবে তিন কে জি’র মধ্যে ৮ মে রাতে মারা যাওয়া কে জি মোস্তফা ছিলেন সত্যিকারের কিংবদন্তি। তার ক্যারিয়ারও সাংবাদিকতার, তবে সাংবাদিক হিসেবে অত খ্যাতিমান নন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেহাদে শিক্ষানবিশ হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ওই বছরেই ‘দৈনিক মজলুম’এ সহ-সম্পাদক পদে নিয়োগ পান এবং পত্রিকার বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এরপর দীর্ঘ বিরতি শেষে ১৯৬৮ সালে সাপ্তাহিক জনতায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
স্বাধীনতার পর কে জি মোস্তফা প্রথমে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’, পরে ‘দৈনিক স্বদেশ’-এ চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ‘দৈনিক জনপদে’ কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ঐ সময় ‘নূপুর’ নামে একটি বিনোদন মাসিকও সম্পাদনা করতেন। ১৯৭৬ সালে বিলুপ্ত সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক হিসেবে কে জি মোস্তফা বি.সি.এস (তথ্য) ক্যাডারভুক্ত হন এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় সিনিয়র সম্পাদক হিসেবে অবসরে যান তিনি।
এক সময় তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকেও ঝুঁকেছিলেন। ‘মায়ার সংসার’, ‘অধিকার’ ও ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজও করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন তিনি। কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা অসংখ্য গান চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপ্রিয় শিল্পী তার গান গেয়েছেন।
তবে এসব কিছু নয়, তাকে অমরত্ব দেওয়ার জন্য একটি গানই যথেষ্ট। মাহমুদুন্নবীর গাওয়া 'আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে...' গানটিই তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট হতে পারতো। কিন্তু যখন জানবেন তালাত মাহমুদের গাওয়া 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে...' গানটিও তার লেখা, তখন নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, তিনি সত্যিই একজন কিংবদন্তি। এই একটি গানই উপমহাদেশ জুড়ে খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাকে।
‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো…’ গানটি রেকর্ড হয় ১৯৬০ সালে। তখন তিনি প্রায় ছাত্রাবস্থায় গানটি লিখেছেন। লিখেছিলেন আবেগ থেকে, সে আবেগ দশকের পর দশক ছুঁয়ে গেছে আমাদের হৃদয়।
একটি গানের পেছনে অন্তত তিনজন ব্যক্তির অবদান থাকে। গীতিকার, সুরকার এবং সবশেষে শিল্পী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা শিল্পীকেই মনে রাখি। সুর বা কথার কথা আমরা ভুলে যাই। ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো…’ এই গানের গীতিকার যে আমাদের সময়ে বেঁচেছিলেন, আমরা কজন জানতাম?
তিনি নিয়মিত প্রেসক্লাবে যেতেন। শুনেছি সেখানে হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিসও করতেন। অনেকেই দেখেছেন, কিন্তু চেনেননি তাকে। আমি গভীর শ্রদ্ধায় দুয়েকবার কথা বলেছি। কিন্তু অত বড় কিংবদন্তির কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি।
সাংবাদিক বন্ধুদের অনেককে দেখিয়েছি, এই লোক কিন্তু কিংবদন্তি। অন্য সব গান বা কবিতা বা সাংবাদিকতার কথা বাদ দিলেও ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো…’ কে জি মোস্তফাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। গত ৬২ বছরে এই গান কোটিবার শুনেছে মানুষ। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশেই তোলপাড় তুলেছিল এই গান। যার আবেদন এখনো ফুরায়নি, কখনো ফুরাবেও না।
আগেই বলেছি, গীতিকবিরাই সবচেয়ে অবহেলিত। কবিসভায় তাদের ঠাঁই নেই। আবার গানের জগতেও থেকে যান উপেক্ষিত। আমরা কোটিবার তার গান শুনেছি, কিন্তু কে জি মোস্তফা এই গান থেকে কয় টাকা পেয়েছেন?
‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো…’ গানটি রেকর্ড হয় ১৯৬০ সালে। তখন তিনি প্রায় ছাত্রাবস্থায় গানটি লিখেছেন। সেই গান লিখে আদৌ টাকা পেয়েছেন কি না, তাও জানি না। তিনি তো আর টাকার জন্য গানটি লেখেননি। লিখেছিলেন আবেগ থেকে, সে আবেগ দশকের পর দশক ছুঁয়ে গেছে আমাদের হৃদয়। কয়েক প্রজন্ম প্রেম করেছে কে জি মোস্তফার লেখা গান শুনে। শেষ পর্যন্ত এটাই গীতিকারের প্রাপ্তি।
পরিণত বয়সে কে জি মোস্তফা এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। কিন্তু তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন শ্রোতাদের হৃদয়ে।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ