ছবি : সংগৃহীত

ক্যান্সার শব্দটা শুনলেই তো ভয় লাগে! ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি ক্যান্সার মরণব্যাধি। ক্যান্সার হলে কেউ বাঁচেন না। আর সেই ক্যান্সার যখন বাসা বাঁধে আপনজনের শরীরে তখন তো কথাই নেই!

চোখের সামনের চারদিক কালো হয়ে আসে, এমন এক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল ২০১০ সালে। মায়ের ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার। চারবছর টানা যুদ্ধ শেষে মা চলে গেলেন সমর বিরতি নিয়ে। আজ বিশ্ব ওভারিয়ান ক্যান্সার দিবসে তাই কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য আবার কলম ধরলাম।

আমার মায়ের জরায়ুর কাছাকাছি একটা ছোট্ট টিউমার হয়েছিল। আর দশ জন বাঙালি নারীর মতোই মাও লজ্জা পেতেন, হয়তো ভয়ও পেতেন। ডাক্তার দেখানোর পর ওষুধ খেয়ে যেতেন অপারেশনের ভয়ে চেপে গিয়েছিলেন সব। কিন্তু টিউমার তো বসে থাকার পাত্র নয়, একসময় তা ক্যান্সারে রূপ নিল। তখন তো আর শত চাইলেও লুকাতে পারলেন না।

সবকিছু জানার পর আমার মনে হয়েছে, কোনো টিউমারকেই অবহেলা করা উচিত নয়। অন্তত ডাক্তারের কাছে তো কিছুই লুকানো যাবে না। আর প্রতিটি পরিবারে অন্তত কারো না কারো সাথে সবকিছু শেয়ার করা খুব জরুরি। নয়তো ক্যান্সার দানা বাঁধবে, পরিণত হবে তখন আর শত চেষ্টা করেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে না।

এরপর শুরু হলো তুমুল ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা। কী, কত প্রকার ও কী কী? বাংলায় কোনো তথ্য নেই। কিনে ফেললাম মেডিকেল ডিকশনারি। বোঝার চেষ্টা করলাম যুদ্ধের ক্ষেত্রটিকে। গুগল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। কত শত তথ্য নামিয়েছি তার অন্ত নেই। সেই থেকে আমার উপলব্ধি ক্যান্সারের বাংলায় একটা তথ্য ভাণ্ডার থাকা খুবই জরুরি। গড়ে তুললাম প্রথম বাংলা ভাষায় ক্যান্সারের তথ্য ভাণ্ডার www.cancerbd.net।

পুরো চার বছরের ক্যান্সার যুদ্ধে সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হলো, ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে তাকে বশে আনা সহজ, খরচও কম হয়। কিন্তু সেটা পরিণত হয়ে গেলে তার লাগাম ধরা সত্যি কঠিন। আর সেকারণেই আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য ক্যান্সারের আর্লি ডিটেকশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি হাসপাতালে মাত্র ২০ টাকায় টিউমার টেস্ট করা যায়। তাই টিউমার হলেও তা টেস্ট করে ফেলা, ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া—এর কোনোই বিকল্প নেই। তাই শুরুতেই শনাক্ত করার কথা বলেছি জনে জনে, বলে যাচ্ছি।

এখন সরকারি প্রায় সবগুলো হাসপাতালেই আছে ক্যান্সার ইউনিট, বিভাগীয় জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠছে বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিট। এছাড়াও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে আছে বিশ্বমানের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা। কিন্তু যেটা নেই সেটা হলো যথার্থ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা।

ক্যান্সার রোগীরা আর দশটা রোগীর চেয়ে বেশি নাজুক সেই বিবেচনায় তাদের জন্য নেই আলাদা কোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা; যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিকিৎসার জন্য বেশি প্রয়োজন।

ক্যান্সার চিকিৎসা হোক কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপি- চিকিৎসা নেওয়ার পরের সাতদিন রোগীর হাজারো সাইড ইফেক্ট দেখা দেয় আর সেই সময়টায় তার দরকার উল্লেখিত বিশেষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা সেবা শুশ্রূষার। আর যখন ক্যান্সার হয়ে যায় বাঁধন ছাড়া তখন চাই পেলিয়েটিভ কেয়ার অর্থাৎ সুনিবিড় যত্ন শুধুমাত্র ব্যথা প্রশমনে। সেখানেও তাকে লাইন ধরতে হয় সাধারণের লাইনেই। এভাবে কি ক্যান্সার চিকিৎসার সুফল আসবে?

এইরকম অসংখ্য সংকটের কথা বললেও শেষ হবে না। তাই শেষ করছি এখানেই, শুধু শেষ একটা অনুযোগের কথা বলেই। ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি পরিবারকে নানান বাস্তবতার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়।

দীর্ঘ অনিশ্চিত এই পথে বন্ধু চাই। সবার আন্তরিকতা চাই নয়তো এই যুদ্ধ জয় প্রায় অসম্ভব। তাই আসুন আমরা ক্যান্সার আক্রান্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াই আন্তরিকতার সাথে।

প্রতিটি মানুষই বাঁচতে চায়। আমরা সবাই পাশে থাকলে সেই চাওটাকে পূরণ করা সম্ভব।

রাফে সাদনান আদেল ।। সংবাদ ও যোগাযোগকর্মী