ছবি : সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথের ওপর মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তিনিও ব্যাসের মহাকাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণের মতো অস্ত্র শক্তির একটা অবসান দেখতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ যেমন ভারতবর্ষের অস্ত্র শক্তি অবসান চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি পৃথিবীতে অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের জয় চেয়েছিলেন। তিনি বড় আশা করে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সেই ভাবী যুগ আসিয়াছে, অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্রকে দাঁড়াইতে হইবে। সেদিন যে মারিতে পারিবে তাহার জিত হইবে না, যে মরিতে পারিবে তাহার জয় হইবে।’

কবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস একজন ছিলেন না। মহাভারত তাই অনেকের লেখা। যে কারণে মহাভারতের শেষে এসে এক হতাশ কৃষ্ণের দেখা মেলে। যিনি জরাগ্রস্ত, মারা যাচ্ছেন। আর মৃত্যু কালে দেখতে পাচ্ছেন- তার শক্তিতে তিনি পৃথিবীর কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন করতে পারেননি। বরং সেই বর্বরতা, সেই অস্ত্র, সেই অসহায় নারী অর্থাৎ কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের ভাষায়, ‘পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ, প্রতিশোধ রমণীর শ্লীলতাহানিতে।’

কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত একবিংশ শতাব্দীতে বসেও একথা বলছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতাব্দীতে আশা করেছিলেন, ‘জগতে কাহারো সাধ্য নাই, দুঃখের শক্তিকে, ত্যাগের শক্তিকে ধর্মের শক্তিকে বলির পশুর মতো শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারে।’

রবীন্দ্রনাথের একথাকে সত্য বলে মানতে সকলেরই ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ বিবেক চায় এটাই সত্য হোক। কিন্তু আজকের এই পৃথিবীতে বসে একজনও কি জোর করে বলতে পারবেন, ত্যাগের শক্তি, দুঃখের শক্তি শেষাবধি জয়লাভ করবে!

হয়তো রবীন্দ্রনাথের এই আশা জেগেছিল, ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীতে মানুষের মনুষ্যত্বের অগ্রযাত্রা দেখে। বিশেষ করে তিনি এই লেখা লিখছেন, ১৯১৭ সালে। যখন বাস্তবে যাই ঘটুক, সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হচ্ছে, দুঃখী মানুষেরা, সাধারণ মানুষেরা, শৃঙ্খলবদ্ধ নারীরা মুক্তি পাচ্ছে।

সমাজতন্ত্রের নামে রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব সফল হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের এই আকাঙ্ক্ষা মোটেই রুশ বিপ্লবকে ঘিরে নয়। বরং অনেক বেশি ব্যাসের মহাভারতের ক্ষাত্র বা ক্ষত্রিয় শক্তির বিপরীতে নিরস্ত্রের ও নারীর জয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো প্রকৃত বিশ্বযুদ্ধে রূপ পায়নি। তখনো তা ইউরোপ ও রুশের ইউরোপ সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার মৃত্যুর মাত্র চার মাস পরে জাপান আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর আক্রমণ করে ঘুমন্ত সিংহ আমেরিকাকে জাগিয়ে দেয়।

কিন্তু মানুষের কাছে তার এই চাওয়া থাকলেও তিনি কি আসলেই দ্রুত পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটবে এমনটা চেয়েছিলেন? কারণ, তিনি তো রাষ্ট্রীয় উচ্ছৃঙ্খলতা চিনতেন। তাই কিন্তু তার পূর্বের এই কথার মাত্র দুই বছর পরে এসেই রাষ্ট্রীয় উচ্ছৃঙ্খলতায় মানুষের চরিত্র কোথায় যায়, আর সেখানে যে প্রকৃত সত্যের কোনো স্থান থাকে না- সেটাই তিনি বড় নির্মমভাবেই বলছেন।

হয়তো তার এ কথায় তখনো যেমন এখনো অনেকে মর্মাহত হতে পারেন। ঐশ্বর্যগর্ব ও দারিদ্র্যের অপমান এই দুইয়েই যে মানুষের প্রবৃত্তি লোলুপ হয়, মানুষ যে তখন ছলনা ও ক্ষমতার শক্তিকে সকলের ওপরে স্থান দিতে মোটেই দ্বিধান্বিত হয় না, এ কথাই নির্মম হলেও সত্য বলেই বলছেন রবীন্দ্রনাথ। আর এখানে ওই শক্তি পীড়িত রাষ্ট্রে মানুষের যে কোনো চরিত্র থাকে না।

সে যে অমঙ্গলকে মঙ্গল বলেই স্বীকার করে নেয়, অতীতেও নির্মমভাবে নিয়েছে তাই রবীন্দ্রনাথ অনেকটা তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ আঘাত দিয়েই স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘অপর পক্ষে একদা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় উচ্ছৃঙ্খলতার সময়ে ভীত পীড়িত প্রজা আপন কবিদের মুখ দিয়ে শক্তির জয়গান গাইয়েছে। কবি কঙ্কণচন্ডী, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসান, প্রকৃত পক্ষে অধর্মেরই জয়গান। সেই কাব্যে অন্যায়কারী, ছলনাময়ী, নিষ্ঠুর শক্তির হাতে শিব পরাভূত। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, এই পরাভব গানকেই মঙ্গলগান নাম দেয়া হলো।’

অন্নদা মঙ্গলে সমস্ত শস্যকে কৃষকের ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া হলো শুধু শিব বা সত্যকে পরাভূত করার জন্যে। দেবী চণ্ডী বা দুর্গার শক্তিকে সবার ওপরে নেওয়ার জন্যে। সেখানে একজন সত্য সুন্দরের প্রতীক, মনুষ্যত্বের প্রতীক—এমনকি সৃষ্টির প্রতীক শিবকে পরাজিত করেই কিন্তু এক অদ্ভুত আনন্দ।

অন্নদামঙ্গল থেকে মনসার ভাসান আরও বেশি মানুষের কাছের। সেখানে মানুষের যে বীর, তাকে ছলনা দিয়ে, অন্যায় দিয়ে পরাজিত করা হচ্ছে। বারবার ছলনাময়ী মনসার কাছে পরাজিত হচ্ছে বীর চাঁদ সওদাগর। তারপরেও চাঁদ সওদাগর নয় শেষাবধি মনসারই জয় হচ্ছে। সেই মনসাই মানুষের পূজা পাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো প্রকৃত বিশ্বযুদ্ধে রূপ পায়নি। তখনো তা ইউরোপ ও রুশের ইউরোপ সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার মৃত্যুর মাত্র চার মাস পরে জাপান আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর আক্রমণ করে ঘুমন্ত সিংহ আমেরিকাকে জাগিয়ে দেয়। আর যুদ্ধ তখন সারা পৃথিবীতে।

বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের যে আস্থা ছিল পশ্চিমা সভ্যতা, অর্থাৎ আধুনিক সভ্যতার ওপর। সেই সভ্যতার অন্দরে ও ভেতরে বিকৃত এক ঝড় ওঠে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। তখন সভ্যতাগুলো কেমন যেন একের সঙ্গে আরেক জড়িয়ে একটা খিচুড়ি বনে যায়। কারণ একদিকে ইউরোপে হিটলার বলছে, ‘থার্ড রিক’, অর্থাৎ রোমান সভ্যতাকে জাগাতে চাচ্ছে। তার সঙ্গে সিনিক সভ্যতার অংশ জাপান সহযোগী হয়ে যাচ্ছে ঘটনা ক্রমে।

আবার সিনিক সভ্যতা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। জাপান তখন কোরিয়া থেকে চীন অবধি উন্মত্ততায় ঘুরছে। রবীন্দ্রনাথের আগের বলা কথা ধরে বলা যায়, ওরা তখন সত্যিই বুদ্ধের কথা বলে বুদ্ধের গায়েই বান মারছে। অন্যদিকে ইউরোপের আধুনিক সভ্যতার বিংশ শতাব্দীর কেন্দ্রস্থল ব্রিটেন, তাদের অনুসারী আমেরিকান সভ্যতা ও চরম অর্থডক্স সভ্যতা যা তখন এক তথাকথিত সমাজতন্ত্রের নামে এক নায়কতন্ত্রের অধীনে সেই রুশ মিলে থার্ড রিক ও সিনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে।

কিন্তু যুদ্ধ সভ্যতা সভ্যতাকে আক্রমণ করছে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। যে ব্যাস নিজের সভ্যতার ভেতরে যুদ্ধ করে সভ্যতাকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন তাও নয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ শুধু ভূমি দখল, সম্পদ দখল, মানুষ হত্যা আর নারীর শরীরের ওপর ‘আরেক য্দ্ধু- যা সভ্যতার লজ্জা।’

রবীন্দ্রনাথের গুরু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস ভারতীয় সভ্যতা থেকে এই অস্ত্র শক্তির অবসান চেয়েছিলেন, যুদ্ধের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, যুদ্ধে কোনো সমাধান হয়নি। ক্ষাত্র বা ক্ষত্রিয় শক্তিই দানবের মতো দাপটে টিকে থাকে। তাই তিনি মানুষের শক্তি চেয়েছিলেন।

আর এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেখা গেল, যারা নিরস্ত্র, যারা মরতে জানে তারা জিতলো না কোথাও। জিতলো আধুনিক মারণাস্ত্রের খেলা। আর সে কি ভয়ংকর খেলা, জার্মানরা ইহুদিদের গ্যাস চেম্বার পোড়াচ্ছে, রুশরা জার্মান মেয়েদের শরীর নিয়ে উল্লাস করছে। অন্যদিকে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ মারা যে কত সোজা তা দেখিয়ে দিচ্ছে আমেরিকা এটম বোমা ফেলে জাপানে।

পৃথিবীর এই নৃশংস ও জটিল রূপ দেখতে হয়নি রবীন্দ্রনাথকে। পৃথিবীর এ রূপ দেখলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার জগৎ যে বদলে যেত তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু এটাও সত্য, তিনি তো সত্য কথাটি আগেই বলেছিলেন, সমস্যা ওই শক্তির পূজা দেওয়া।

রবীন্দ্রনাথের গুরু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস ভারতীয় সভ্যতা থেকে এই অস্ত্র শক্তির অবসান চেয়েছিলেন, যুদ্ধের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, যুদ্ধে কোনো সমাধান হয়নি। ক্ষাত্র বা ক্ষত্রিয় শক্তিই দানবের মতো দাপটে টিকে থাকে। তাই তিনি মানুষের শক্তি চেয়েছিলেন।

উচ্ছৃঙ্খল রাষ্ট্র শক্তির উপাখ্যানকে মঙ্গলের গান নয়, তাকে ঘৃণা করে মানুষের জীবনের শক্তিকে তিনি শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তিনি কোনো মতেই যুদ্ধের এবং রাষ্ট্রের শক্তিকে শেষ সত্য হিসেবে মানতে রাজী ছিলেন না। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কালে জীবনানন্দ দাশ বলছেন, ‘রণরক্ত সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।’ বাস্তবে শেষ সত্য, ব্যাস থেকে রবীন্দ্রনাথ যা চেয়েছিলেন তাই- আর তা হলো মানুষের শক্তির জয়।

কিন্তু আজ এ মুহূর্তে যখন পৃথিবী আবার রণরক্ত ভূমি। তারপরেও সেই মহাভারতের যুদ্ধ থেকে, সেই রোমান যুদ্ধ, অটোম্যান যুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই কাব্য ও সত্য সবই যদি মেলানো হয় তাহলেও আসলে পৃথিবীর মুক্তির পথ কি রবীন্দ্রনাথই বলেননি। আসলে তিনিই কি সত্য নন, অস্ত্র শক্তি, ছলনা শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকেই জিততে হবে। কিন্তু সে কবে?

বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, ব্যাস, রবীন্দ্রনাথ হয়ে এই যাত্রা কত দীর্ঘ? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, এই একবিংশ শতাব্দী, এই সভ্যতা আরও দীর্ঘ করে দিয়ে গেছে সে পথ। কারণ, রবীন্দ্রনাথ তো একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্যায়নের ভয়াবহতার কথা ১৯১৫ তে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক সময়ে জিনিস ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি, এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’

বাস্তবে এটাই সভ্যতার সব থেকে বড় সংকট। মানুষ বৈশ্যের কাছে, অর্থাৎ ব্যবসায়ীর কাছে তার রাষ্ট্র’র স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা, সভ্যতার স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা সবই হারিয়েছে। এখন মানুষ শুধু বৈশ্যের সম্পদ। তারপরেও এই মানুষের ওপরই রবীন্দ্রনাথের মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আস্থা রাখতে হবে। কারণ, পরিবর্তন শেষ অবধি মানুষই করবে।

স্বদেশ রায় ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব