৪ জুন রাত সাড়ে ৯টা। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। ৫ জুন তা গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে মানুষের বিশেষ করে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যুর দৃশ্য দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের নিউজের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।

৫ জুন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাস-ট্রাক বাসের সংঘর্ষে প্রাণ হারান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তিনজন বিজ্ঞানীসহ কয়েকজন। বিভিন্ন সময়ের একই ধরনের দুর্ঘটনাগুলো মনে করে বিমর্ষ চিত্তে ভাবছিলাম, মৃত্যু উপত্যকাই কি আমার দেশ? অপমৃত্যুই কি এখানকার মানুষের নিয়তি? আমারও কি এমনই অপমৃত্যু হবে?

নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্ণ হওয়ার পরদিনই হলো সীতাকুণ্ড ট্রাজেডি। দেশের মানুষ সাক্ষী হলো আরও এক বিভীষিকাময় ঘটনার। ২০১০ সালের ৩ জুন ঢাকার নিমতলীতে আগুনে পুড়ে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল।

২০১২ সালের নভেম্বরে গার্মেন্টস নগরী আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডে আগুন লেগে মারা যান ১১১ জন পোশাক শ্রমিক। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পুরান ঢাকার চকবাজারের, চুড়িহাট্টায় ঘটে যায় আগুনের তাণ্ডব। আগুন কেড়ে নেয় ৭১টি তাজা প্রাণ।

নিমতলী, চুড়িহাট্টা আর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ একই সূত্রে গাঁথা। এই তিনটি স্থানেই প্রায় একইভাবে রাতের বেলা অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় এবং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

নিমতলীর ট্রাজেডির পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য ১৭ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল। কিন্তু এক যুগ পার হলেও সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

এছাড়া প্রতিটি স্থানেই শুরুতে আগুন লাগে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে, পরে তা কেমিক্যালের কারণে ছড়িয়ে পড়ে। যত্রতত্র কেমিক্যাল গোডাউন তৈরি এবং এর অগ্নিকাণ্ডের কারণেই বারবার ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। 

এই মৃত্যুর শেষ কোথায়? আগুনের এতগুলো বড় ঘটনার পরও আমাদের বোধোদয় হয়নি। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আবার ৪ জুন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সীতাকুণ্ডে।

নিমতলীর ট্রাজেডির পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য ১৭ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল। কিন্তু এক যুগ পার হলেও সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

এক যুগে প্রায় আড়াইশর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে কেমিক্যালে আগুনের কারণে। চুড়িহাট্টা ও নিমতলীর ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নানা সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ সময়েও এই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। এই কারণেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর চট্টগ্রামে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে এত বেশি পরিমাণে রাসায়নিক দ্রব্য মজুত রাখা হয়েছিল, তা তাদের জানানো হয়নি। এমনকি এটির অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

এখানে আমার প্রশ্ন হলো, যদি অনুমোদন নেওয়া নাই থাকে তাহলে এত বড় একটি গুদাম কীভাবে এতদিন তার কার্যক্রম চালালো? এগুলোকে দেখভাল করার দায়িত্বে ছিল কে?

রাসায়নিক দ্রব্য বা উপকরণের তীব্রতা ভেদে মজুদ বা গুদামজাতকরণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধি মানতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাসায়নিক কেমিক্যাল আমদানিকারকেরা আমদানি করা রাসায়নিক দ্রব্য কীভাবে মজুত করবে, তার কোনো সামগ্রিক নীতিমালা তৈরি হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরান ঢাকার অন্তত ৪৪টি এলাকায় অন্তত সাড়ে তিন হাজার রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম রয়েছে।

বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালের বিস্ফোরক আইনের মাধ্যমে বিস্ফোরক তৈরি, সংরক্ষণ বা মজুত, ব্যবহার, বিক্রয়, পরিবহন ও আমদানি-রফতানি আইন করা হয়। সেই আইনের উপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে একটি বিধিমালাও তৈরি করা হয়।

বিধিমালায় কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য মজুতের বিধান সম্পর্কে ১৩৯তম ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে—‘স্টোর হাউজ উত্তমরূপে এবং মজবুতভাবে ইট, পাথর এবং কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করতে হবে এবং তা বন্ধ রাখতে হবে, যাতে অননুমোদিত কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করতে না পারে এবং বাইরে থেকে অগ্নিসৃষ্ট কোনো বিপদ হতে নিরাপদ থাকে। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

কিন্তু বিএম কনটেইনার ডিপোতে উন্মুক্ত স্থানে রাসায়নিক ভর্তি কনটেইনার রাখার পাশাপাশি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়াই একটি টিনশেড ঘরে এবং উন্মুক্ত স্থানে বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুত করা হয়েছিল।

ব্যবসায়ীদেরও কেমিক্যাল দ্রব্য মজুত, সংগ্রহ, বিপণন ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। নীতিমালা অনুযায়ী, বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ মজুতদার ও দোকানের চারপাশে অন্তত ২২ ফুট ফাঁকা জায়গা রেখে ১০০ মিটারের মধ্যে স্থায়ী স্থাপনার চিত্র, মজুতদারের অবস্থান ও নকশা তৈরি করে বিস্ফোরক পরিদপ্তরে জমা দিতে হয়। তবে বাস্তবে এসব নীতিমালার কোনো তোয়াক্কা না করেই পুরান ঢাকার আবাসিক ভবন ঘিরে যুগ যুগ ধরে কেমিক্যাল ব্যবসা চলে আসছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরান ঢাকার অন্তত ৪৪টি এলাকায় অন্তত সাড়ে তিন হাজার রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম রয়েছে। আগের মতোই অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে এসব রাসায়নিক গুদাম পরিচালিত হচ্ছে। পুরানো ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণও ছিল যথাযথ নিয়মনীতি না মেনে গুদামে রাসায়নিক দ্রব্য মজুতে রাখা।

দুর্ঘটনার পর টনক নড়ে আমার মতো দায়িত্বশীল সকলের। তার আগে সকলে অচেতন অবস্থায় থাকে। দুর্ঘটনা ঘটলেই আসে প্রতিষ্ঠানের নানান ব্যর্থতার কথা। কিন্তু সেই সকল প্রতিষ্ঠানে থেকে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন ও মেনে চলার মনোভাব দেখা যায় না। এই কারণে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বারবার।

নিমতলী, চুড়িহাট্টা এবং সীতাকুণ্ডের মতো এমন ট্রাজেডি আমরা আর চাই না। বিগত দিনের ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আধুনিক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ আমদানি ও ব্যবসা পরিচালিত হোক।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়