মগবাজারের বিস্ফোরণ আরেকবার জানিয়ে দিল, ঢাকা শহরে আমরা কতটা অনিরাপদ, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছি। ঘরে, অফিসে, দোকানে, রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে—কোথাও আমরা কেউ নিরাপদ নই। কখন কার জন্য মৃত্যু কোথায় ফাঁদ পেতে আছে- আমরা কেউ জানি না। আর এই মৃত্যুফাঁদ থেকে আমাদের বাঁচানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগও চোখে পড়ে না।

মগবাজারের ঘটনায় সর্বশেষ ১০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে, হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন আরও বেশ কয়েকজন। আমরা জানি না, তাদের মধ্যে কজন বেঁচে উঠবেন আর কজন না ফেরার দেশে চলে যাবেন।

যারা বেঁচে থাকবেন, তারাও আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেবন- এমন আশা কম, কারণ শরীরের একটা বিরাট অংশ দগ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে—এই আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কদিন ধরে এই বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, টেলিভিশনে টক শো হচ্ছে। সরকার একের পর এক তদন্ত কমিটি করছে, আর আমরা নাগরিকরা ভাবছি, যাক এবার কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে এই রকম দুর্ঘটনা বন্ধ করার।

আমরা এও জানি, এই আলোচনা দুদিন পরে থেমে যাবে, কারণ মিডিয়ার সামনে তখন অন্য কোনো ইস্যু এসে হাজির হবে এবং সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়বেন অনাগত সেই ইস্যু নিয়ে এবং আমরা সকলে দিব্যি ভুলে যাব মগবাজারের বিস্ফোরণ

কিন্তু আমরা এও জানি, এই আলোচনা দুদিন পরে থেমে যাবে, কারণ মিডিয়ার সামনে তখন অন্য কোনো ইস্যু এসে হাজির হবে এবং সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়বেন অনাগত সেই ইস্যু নিয়ে এবং আমরা সকলে দিব্যি ভুলে যাব মগবাজারের বিস্ফোরণ, এই ১০টা মানুষের মৃত্যু এবং আরও অনেকের পঙ্গুত্বের কথা।
যেমন আমরা ভুলে গেছি নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা। আমাদের কারো মনেও নেই যে তখন পত্রিকায় বড় বড় হেড লাইন হয়েছিল, পুরান ঢাকা যেন বসে আছে একটা বিশাল বোমার ওপর। প্রতিটি বাড়ির নিচের তলায় বা দোতলায় বা অনেক ক্ষেত্রে পুরো বাড়ি জুড়ে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। একবার কোথাও আগুন লাগলে মুহূর্তের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায় এবং পানি দিয়ে সেই আগুন নেভানোও যায় না।

নিমতলী ট্র্যাজেডিতে শতাধিক মানুষের আগুনে পুড়ে বীভৎস মৃত্যুর পর কিছুদিন এ নিয়ে বেশ হইচই হলো, কিন্তু তারপর আবার যেই লাউ সেই কদু। আজকে এখন একবার পুরান ঢাকার ইসলামপুর, চকবাজার বা অন্য কোনো এলাকায় হেঁটে আসুন হে নগর পিতা, নগর ভ্রাতা- ভগ্নি- মাতা; দেখবেন এখনো আগের মতোই আছে সবকিছু।

সব কেমিকেল গোডাউন আগের মতোই আছে, সেগুলো নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা নেই, কোথাও আগুন লাগলে তা নেভানোর ব্যবস্থা নেই—এমনকি দগ্ধ মানুষকে হাসপাতালে নেওয়ারও ব্যবস্থা নেই।

বলছিলাম ঝুঁকির কথা, ঢাকা শহরে আমরা যে কেবল আগুনে পুড়ে মরার ঝুঁকির মধ্যে বাস করি তা নয়। আমাদের মাথার ওপরে যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে কোনো না কোনো বাড়ি, ভবন বা দেয়াল। কারণ ভবন নির্মাণে আমরা কোনো নিয়মকানুন মানি না, মানতেও হয় না কারণ আমরা সবকিছু ম্যানেজ করি, ম্যানেজ করে ফেলতে পারি।

এখন বর্ষাকাল, ঢাকা শহরের বহু বড় বড় গাছের গোড়ায় কোনো মাটি নেই। প্রতি বর্ষায় তাই বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে গেলে বা একটু জোড়ে বাতাস উঠলে আমাদের মাথার ওপর আছড়ে পড়ে বিশাল গাছ। প্রতিবছর গাছের নিচে প্রাণ হারায় অনেক মানুষ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন দপ্তর তদন্ত কমিটি গঠনে যতটা আন্তরিক, ততটাই উদাসীন সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের ব্যাপারে এবং আরও উদাসীন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেওয়া পরামর্শ বাস্তবায়নে।

এই বর্ষায় আরেক মৃত্যুফাঁদের নাম বিদ্যুতের তার। হাই ভোল্টেজের বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে থাকে পথে, বৃষ্টির পানির নিচে। আর তাতে জড়িয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায় কিছু মানুষ।

এখানে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটছে সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারের। কারণ বহুদিন আগে গাড়িতে সিএনজি সিলিন্ডারগুলো লাগানোর পর তার মেয়াদ আছে কি না বা সেগুলো ঠিক আছে কি না তা দেখার কোনো দায়িত্ব আমাদের নেই।

এরকম হাজারো দুর্যোগ বা ঝুঁকির তালিকা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু এইসব ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকার কি উপায় আছে তা বলা সম্ভব নয়। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলো দেখাশোনা করে, তাদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে মনোযোগী নয়, আন্তরিকও নয়।

সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর বা অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে কখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে দেখিনি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন দপ্তর তদন্ত কমিটি গঠনে যতটা আন্তরিক, ততটাই উদাসীন সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের ব্যাপারে এবং আরও উদাসীন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেওয়া পরামর্শ বাস্তবায়নে। তাই আমরা যেই তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই থেকে যাই বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।

জ. ই. মামুন ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন বাংলা