ছবি : সংগৃহীত

একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, একটি সিটি নির্বাচন। কিন্তু এর গুরুত্ব জাতীয় নির্বাচনের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তার জন্য প্রথম পরীক্ষা এবং এর মাধ্যমেই দেশের মানুষ বুঝতে পারবে এই কমিশন আগামী সংসদ নির্বাচন কতটা সক্ষমতার সাথে ও সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে

কিছুটা হয়তো এর মধ্যে মানুষ বুঝতেও শুরু করেছে, বিশেষ করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনী আচরণবিধি মোতাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য এলাকায় থাকবেন না এবং এলাকায় থেকে কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না বা প্রচারণা চালাবেন না।

অথচ তিনি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে সেটাই করছিলেন। তাই তাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল এলাকা ছাড়ার জন্য। কিন্তু এমপি বাহার এলাকা ছাড়েননি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে চিঠি দেওয়ার পরও কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কুমিল্লা সিটির নির্বাচনী এলাকায় না ছাড়ায় গণমাধ্যমের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

ইসি’র চিঠি পাওয়ার পরও একজন সংসদ সদস্য সেই নির্দেশনাকে সম্মান না জানালে কমিশনের তেমন কিছু করার নেই—এমনটিই বলছেন সিইসি। যদি একটি স্থানীয় নির্বাচনে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে কোনো ভরসা পাবে মানুষ যে, এদের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনও প্রভাবমুক্ত থাকবে?

মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কুমিল্লা মহানগর সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। বিএনপি নেই, কিন্তু আছে এবং সেই কারণেই আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে হালকাভাবে নেয়নি।

তফসিল অনুযায়ী কুমিল্লা সিটির ভোট আগামী ১৫ জুন। এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোট নেওয়া হবে।

সিটিতে মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন, পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। অতীত বা নিকট অতীতের সব নির্বাচনী সহিংসতা, কেন্দ্র ও বুথ দখলের বহুবিধ ঘটনায় কোনটার পেছনে কে বা কারা, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক তর্ক ও মিডিয়ার প্রচার আছে।

আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো ক্রমেই একচ্ছত্রভাবে শাসক দলের নিজেদের বিরোধের প্রদর্শনী হয়ে উঠছে বিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতির কারণে। এই কুমিল্লা নির্বাচনেও বড় দল বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। তবে তারই নেতা এবং দুইবার নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু অংশ নিচ্ছেন।

মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কুমিল্লা মহানগর সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। বিএনপি নেই, কিন্তু আছে এবং সেই কারণেই আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে হালকাভাবে নেয়নি।

কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে যদি প্রশ্ন উঠে তাহলে বড় রাজনৈতিক বিতর্কের জন্য তৈরি থাকতে হবে কমিশনকে। স্বাভাবিকভাবেই আসন্ন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলে এর প্রভাব পড়বে ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে। দেশ বিদেশে এই নির্বাচনকে ঘিরে রয়েছে অনেক উৎসাহ ও উদ্বেগ।

প্রতিটি নির্বাচনে যেসব হিসাবনিকাশ হয় কুমিল্লা সিটি নির্বাচন নিয়েও এর ব্যতিক্রম নেই। সবার আগে আসে ভোটের পরিবেশ যেন নির্বাচকমণ্ডলী অর্থাৎ ভোটাররা ঠিকমতো ভোট দিতে পারেন।

এমপি বাহারের সাথে ইসি’র দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও সংশয়ের জন্ম দেয় পরিবেশ নিয়ে। ভোটারদের ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে কমিশনকে। প্রশ্ন আছে ইভিএম নিয়েও।

আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দল ও প্রার্থী ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ব্যালটে ভোট নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাই ইভিএম-এর ভোট কতটা গ্রহণযোগ্য হলো সেটাও একটা বড় নিয়ামক হবে আগামী নির্বাচনের জন্য।

এমপি বাহারের সাথে ইসি’র দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও সংশয়ের জন্ম দেয় পরিবেশ নিয়ে। ভোটারদের ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে কমিশনকে। প্রশ্ন আছে ইভিএম নিয়েও...

ইভিএম-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, বুথের ভেতর সরকারি দলের কিছু লোক থাকে যারা ভোটারদের সহায়তার নামে নিজেদের মতো ভোট দিতে দেয় না। আমরা জানি না কুমিল্লা সিটির ভোট এই দোষ থেকে মুক্ত হতে পারবে কি না।      

এরপরই উঠে ভোটের নানা সমীকরণের প্রশ্ন। নতুন করে যোগ হওয়া ২২ হাজার ভোটার এবারের মেয়র নির্বাচনে একটি বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকেরা। এবারের নির্বাচনে জয় নির্ধারণকে নতুন ভোটাররা খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করবে

নতুন হওয়া এই ভোটারদের প্রায় অধিকাংশই তরুণ। তরুণেরা দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা, ব্যক্তি ইমেজ ও জনপ্রিয়তা এবং এলাকার জন্য বিবেচনায় রেখে ভোট দিতে চাইবেন যদি তারা তাদের ভোট দিতে পারেন। জলাবদ্ধতা, যানজটের সমস্যাসহ নগরীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নিজস্ব মতামত আছে তরুণ সমাজের।

এদেশে নির্বাচনী সহিংসতা অনেকটাই যেন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে অনেকখানি। নির্বাচন মানেই মানুষের জন্য যথেষ্ট চাপ এবং উদ্বেগের।

বিপক্ষের ভোট রুখতে সন্ত্রাসকে তাই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। অনেক ক্ষেত্রে আগে থেকেই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যে, তার ভোট দিতেই আসেন না। এমন এক অবস্থা হয়েছে যে, কোথাও কোথাও জামানত হারিয়েও প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।

তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে ভোটের পরিবেশ ও ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে গণতন্ত্রের ভিত যত মজবুত হবে এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ যত দৃঢ় হবে, নির্বাচনী সন্ত্রাস ততই কমবে, এটাই স্বাভাবিক।

সাধারণ ভোটার থেকে রাজনৈতিক দল, সবারই এটা বোঝা জরুরি। কুমিল্লার সিটি নির্বাচন ভোটারদের মনে এই বিশ্বাস সঞ্চারিত করবে বলেই আশা করছি যদি কাজী হাবিবুল আওয়াল কমিশন মেরুদণ্ড সোজা রেখে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান নির্বাহী, গ্লোবাল টেলিভিশন