ছবি : সংগৃহীত

আজকের ভার্চুয়াল জগতের প্রাণশক্তি হচ্ছে ইন্টারনেট। আর এর শরীরী কাঠামো হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস। ইন্টারনেট না থাকলে ডিজিটাল ডিভাইসগুলো প্রাণীর মৃত শরীরের মতো বিবেচনা করা যায়। আর শরীর ছাড়া প্রাণশক্তিও মূল্যহীন।

সময়ের বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার পক্ষে এখন আর এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাইরে থাকা সম্ভব নয়। বাইরে থাকতে পারেন, কিন্তু তাহলে আপনি পিছিয়ে পড়াদের দলে থাকবেন, যেখানে আপনার এই সময়ের মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিও দুর্বল হয়ে যাবে। আর ভার্চুয়াল দুনিয়ায় থাকা মানে আপনাকে ইন্টারনেট আর ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গেই থাকতে হবে।

দেশে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ইন্টারনেট আর ডিজিটাল ডিভাইস দুটোর দামই বাড়ানো হয়েছে। অতএব আপনাকে এখন চড়া মূল্য দিয়েই ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল থাকতে হলে কিংবা ডিজিটাল হতে হবে!

প্রথমেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে নতুন করে ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপের প্রসঙ্গে আসি। করোনা মহামারির নতুন বাস্তবতায় দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে মোট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ৮০০ জিবিপিএস ছিল, সেটা এখন তিন হাজার জিবিপিএস ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি উভয় পর্যায়েই বেড়েছে।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডদের (আইএসপি) ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৫৭ লাখ ৪২ হাজার। সেই গ্রাহক সংখ্যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়ায় ৯৫ লাখ ২২ হাজার। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষে গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার।

ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে মহামারির সময়ে অনলাইন ক্লাস, অফিসের জন্য মোবাইল ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করে নিশ্চিত থাকা যায়নি। বাসায় একটা ব্রডব্যান্ড সংযোগ কষ্ট করে হলেও নিতে হয়েছে।

একটা রাউটার দিয়ে বাসার পাঁচ-ছয় জন প্রায় একই গতিতে স্বচ্ছন্দেই অনলাইনে নিজেদের কাজ চালিয়ে নিতে পেরেছেন। সব আইএসপি অপারেটরদের সার্ভিস খুব ভাল কিংবা একই রকম ছিল, সেটা বলব না, কিন্তু গড়পড়তা বিশ্বস্ত একটা সার্ভিস মহামারির সময়ে আইএসপিদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, মোবাইল ইন্টারনেটের মতো অনিশ্চয়তায় গ্রাহকদের পড়তে হয়নি।

কারণ এখন পর্যন্ত দেশে মোবাইল অপারেটরদের বিজ্ঞাপনেই কেবল সবসময় ‘ফোরজি ফাস্টেট’ ইন্টারনেট পাওয়া যায়, ডিভাইসে নয়। ডিভাইসে মোবাইল ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সবসময়ই গভীর সন্দেহের দোলাচলের ভেতরে থাকে এবং গ্রাহককেও রাখে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ শতাংশ নতুন অগ্রিম কর দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগের বিস্তৃতিকে থমকে দাঁড় করাবে, এনিয়ে সন্দেহ নাই। কারণ এই আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগের দেশীয় ব্যবসায়ী। যেগুলো খুব বড় আইএসপি সেগুলোও একটা মোবাইল অপারেটরের কাছে বড় নদীর পাশে ছোট্ট খালের মতো।

তবে ছোট হলেও দেশে বিপদের সময়ে এই আইএসপিরাই দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মানুষকে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সর্বশেষ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘এক দেশ এক রেট’ চালুর পর ব্রডব্যান্ড সংযোগ দ্রুত বিকাশের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।

এর ফলে দেশে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবায় অন্তর্ভুক্ত করার এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমারও সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে ১০ শতাংশ অগ্রিম কর সব সম্ভাবনারই গলা টিপে ধরার শামিল। আরও একটা কথা, দেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবার (আইটিএস) অন্তর্ভুক্ত হলে কর রেয়াতের একটি নীতিমালা আছে।

আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে আইএসপি সেবাকে যৌক্তিক বিবেচনা থেকে আইটিএস অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ এপ্রিল গণভবনে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ এর তৃতীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয় আইএসপিকে আইটিএসে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে বাজেটে সেই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটেনি।

এবার আসি ডিভাইসের কথায়। বর্তমানে মোবাইল ডিভাইসের জনপ্রিয়তা বেশি। মহামারির পূর্ব পর্যন্ত ল্যাপটপ শখের পণ্য হলেও এটা এখন প্রায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে।

খুব কষ্ট করে হলেও, ধারদেনা করে হলেও একটা ল্যাপটপ কেনার চেষ্টা হচ্ছে পরিবারগুলোতে। কারণ একটা ডেস্কটপ বহন করা যায় না। এর একটা ল্যাপটপ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী বহন করে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। আর স্মার্টফোনের কথা তো বলাই বাহুল্য।

দেশে আন্তর্জাতিক বড় ব্র্যান্ড ও দেশীয় কয়েকটি কোম্পানির কারখানা স্থাপনের পর স্মার্টফোনের দাম কিছুটা কমেও আসে। তারপরও এখনো স্মার্টফোন বেশিরভাগ মানুষের হাতের নাগালে নয়।

বিটিআরসি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ীই বর্তমানে ৬১ শতাংশ মানুষ ফিচার বা বেসিক ফোন এবং ৩৯ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল সব নাগরিকের কাছে পৌঁছাতে হলে এখন দরকার স্মার্টফোনের আরও বিস্তৃতি।

একটা সময় প্রস্তাবিত বাজেটে স্মার্টফোনের দাম বাড়ানোর আয়োজন করা হয়েছে। খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে যে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছি বিগত বছরগুলোতে, এবার সেটা আবার নতুন করে আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ফিচার ফোন হোক আর স্মার্টফোন হোক, হ্যান্ডসেটের দাম গড়ে ৫ শতাংশ তো বাড়বেই!

একইসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে ল্যাপটপ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। সম্ভবত, সরকারের সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আমদানি পর্যায়ে কর বাড়ানো হলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশে কারখানা স্থাপন করতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্মার্টফোন আর ল্যাপটপের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উভয় ক্ষেত্রে উৎপাদন, চাহিদা এবং বাজারের ধরনের বড় পার্থক্য আছে।

তাই ল্যাপটপকে স্মার্টফোনের বাজারের প্যারামিটার দিয়ে মাপলে চলবে না। বাংলাদেশে চাহিদা আগের তুলনায় বাড়লেও ল্যাপটপের বাজার এত বড় নয় একটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে যেতে খুব বেশি উৎসাহিত হবে!

এটাও মনে রাখা দরকার দেশে স্যামসাং, ওপ্পো’র এর মতো একাধিক আন্তর্জাতিক কোম্পানি দেশে কারখানা স্থাপনের পরই কিন্তু স্মার্টফোনে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। তাহলে ল্যাপটপের ক্ষেত্রে এই ধরনের অযৌক্তিক, অবাস্তব সিদ্ধান্ত কেন?

মহামারির পর এমনিতেই ল্যাপটপের দাম বেড়েছে, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। ফলে কম্পিউটার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে যেতে শুরু করেছে।

আবার দেশের ল্যাপটপের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশিই আমদানি দিয়েই মেটাতে হচ্ছে। একটিমাত্র কোম্পানি সামান্য কিছু ল্যাপটপ উৎপাদন করে যেগুলোর গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট অসন্তুষ্টির কারণ আছে গ্রাহকদের। এই অবস্থায় আমদানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের অর্থ হচ্ছে, ওই একটিমাত্র কোম্পানির নিম্নমানের ল্যাপটপই বেশি দামে গ্রাহকদের কিনতে বাধ্য করা!

আমরা এর আগে দেখেছি, এই একটি কোম্পানির ভীষণ দাপট, তাদের কাছ থেকে চীনে উৎপাদিত অখ্যাত ব্র্যান্ডের ট্যাব না কেনার কারণে দেশের আদমশুমারির মতো অত্যন্ত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজও দফায় দফায় পেছাতে হয়েছে। তাহলে কি এই একটি কোম্পানির কাছেই ১৮ কোটি মানুষের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন ‘বন্ধক’ রেখে দেওয়া হবে?

এবারের বাজেটে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর কারণে মোবাইল অপারেটররা বেশ খুশি বলেই মনে হচ্ছে। অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব বাজেটের পর আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দুই দিনেও জানায়নি। এর আগে বিটিআরসি অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে ‘আনলিমিটেড’ প্যাকেজের নামে মোবাইল অপারেটরদের জন্য অবিশ্বাস্য গোঁজামিলের প্যাকেজ অনুমোদন করেছে যেখানে ১৫ জিবি’র একটি প্যাকেজেনর দাম ১০৯০ টাকা ধরা হয়েছে!

প্রস্তাবিত বাজেট এই গোঁজামিলের প্যাকেজ নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে কানামাছি খেলতে মোবাইল অপারেটরদের দারুণ উৎসাহিত করবে নিশ্চয়! তারপরও অখুশির কারণ আছে। কারণ ২ শতাংশ ন্যূনতম করের বোঝা মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে এই বাজেটেও থেকেই গেছে।

এই অযৌক্তিক ন্যূনতম কর দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটরকে প্রভাবিত না করলেও দুই নম্বরে থাকা অপারেটরকেও চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির ভেতরেই রাখবে।

রাশেদ মেহেদী ।। সাংবাদিক