ছবি : সংগৃহীত

জলের প্রাচীরে বন্দি মানুষ। সিলেট-সুনামগঞ্জের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ এলাকা জলে। নিমজ্জিত। শুকনো স্থলভাগ ক্রমশ দুর্লভ হয়ে উঠছে। সুনামগঞ্জ বিচ্ছিন্ন এক জনপদ এখন।

বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইলের মাধ্যমে ঐ জনপদে আটকে পড়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। সুনামগঞ্জ জেলা ও উপজেলা শহরের প্রশাসনও এখন অসহায়।

পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের সামর্থ্যটুকু তাদের নেই। সংকট দেখা দিয়েছে নৌকার। সেনা-নৌ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার কাজে নামলেও, হাওরের বিশাল জনপদের মানুষের কাছে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি।

জলবন্দি মানুষেরা খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে পড়েছে। তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়াটাও এখন চ্যালেঞ্জের। কোনো কোনো বাড়িতে প্রবীণ, নারী ও শিশুরা একলা আটকা পড়ে আছে। স্বজনেরা তাদের খোঁজটুকু পাচ্ছেন না।

বিভাগীয় শহর সিলেটেও একই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিমান, ট্রেনে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের বেশিরভাগ আবাসে পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয়স্থলে যাওয়ারও উপায় নেই। এখানেও নৌকা ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

প্রকৃতি নীরবে সয়ে গেল। কিন্তু প্রকৃতি নিজেও যে বাঁচতে চায়। এত নির্যাতন সইবার পরেও হয়তো মানুষকে বাঁচাতেই নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় প্রকৃতি...

২০১৭ ,২০০৪ এমনকি ১৯৯৮ ও ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও সিলেটের মানুষ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। জল আচমকা এসে এভাবে আটকে দেয়নি এই অঞ্চলের মানুষদের। বৃষ্টিপাতও পরিমাণের দিক থেকে স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙেছে।

তবে বৃষ্টিপাত, ঢলের পানি ও বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জের মানুষকে এত অসহায় হতে দেখিনি কখনো। সিলেট, সুনামগঞ্জের আকস্মিক বন্যা দেখার সুযোগ হয়েছে একাধিকবার।

২০০৪ সালের বন্যার সময়েও সিলেট, সুনামগঞ্জের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। নৌকার চেয়ে সড়কে পানি ভেঙে হেঁটে গেছি বহুপথ। বাঁধ ভেঙে যাওয়া হাওরও দেখা আছে।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে তখন থেকেই পানি, নদী, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানুষদের কথা তুলে ধরে আসছি-জলের যত্ন নিতে হবে। হাওর ও নদীকে ভালোবাসা ও আদর দিতে হবে। প্রকৃতির সহজ চলাচলে বাঁধা দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেই সব কথা জলে ভেসে কোথায় চলে গেছে, জানি না।

হাওর, নদীকে বর্জ্যের ভাগাড় বানিয়ে ফেললাম। নদী, হাওরের বিশাল জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগের রুচি হারিয়ে, আমরা হাওরের বুক চিরে সড়ক নিয়ে গেলাম। অবারিত হাওরের মাঝে স্থাপনা তৈরি করেছি যেখানে যেমন খুশি।

জলের অবাধ চলাচলে কপাট বসিয়ে দিলাম। নদীকে যত ভাবে খুশি খুন করা যায়, তাই করলাম। প্রকৃতি নীরবে সয়ে গেল। কিন্তু প্রকৃতি নিজেও যে বাঁচতে চায়। এত নির্যাতন সইবার পরেও হয়তো মানুষকে বাঁচাতেই নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় প্রকৃতি। তাই তার প্রতিবাদ, বাঁধ ভাঙার হুঙ্কার আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোটেও পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব ছিল না। মটরগাড়ি চড়ে বাড়ি ও বাজারে পৌঁছানোর স্বপ্নে যত্র তত্র সড়ক, কালভার্ট ও সেতু তৈরি করে নিজ বন্দিশালা তৈরি করেছি আমরাই।

আসাম ও মেঘালয়ের নেমে আসা ঢল সিলেট, সুনামগঞ্জে অর্থাৎ সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকা হয়ে নেমে যাবে, এটা প্রাকৃতিক নকশা। এই জনপদের মানুষ এতে কখনো বিচলিত হয় না। বরং এই নকশা মেনেই তাদের কৃষি ও আবাসের অভ্যাস তৈরি করা।

কখনো আসাম ও মেঘালয়ে অতি বৃষ্টি হলে জলের আফাল বা ঢেউ বড় হবে এত এখানকার মানুষের তা জানাই আছে। কিন্তু তারা হয়তো জানতো না, তারা নিজেরা পানির স্বাভাবিক চলাচলে একের পর এক যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিল, তাতেই তাদের বন্দি হয়ে পড়তে হবে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওর, নদীর জলও যে গতি ও পরিমাণে সরে যাওয়ার কথা, সেই গতি অতিশ্লথ করে দিয়েছি আমরাই। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোটেও পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব ছিল না। মটরগাড়ি চড়ে বাড়ি ও বাজারে পৌঁছানোর স্বপ্নে যত্র তত্র সড়ক, কালভার্ট ও সেতু তৈরি করে নিজ বন্দিশালা তৈরি করেছি আমরাই।

সমস্যা হলো এই যে ভয়াবহ দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, সেখান থেকে প্রকৃতি আমাদের মুক্তি দেবে। কিন্তু মুক্তি মিললেই আবার আমরা হাওর, নদী জল ধ্বংসে নেমে পড়ব। তখন আরও ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর উপায় কি?

বন্যা উত্তরেও উঁকি দিয়েছে। সুরমার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা প্লাবিত হলে, দেশে বন্যার স্থায়িত্ব বাড়বে। যার প্রভাবে বাজারে স্ফীত হবে মূল্য। তাই আমাদের সর্বক্ষেত্রে সংযমী হওয়া প্রয়োজন।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী