ওয়ান ইলাভেন সরকারের সময় একটি স্লোগান বেশ জোরালো ছিল তা হলো, ‘বেশি করে আলু খাই, ভাতের ওপর চাপ কমাই।’ এবারও কোভিডের অভিঘাত মোকাবিলায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য পণ্যে শুল্ক ছাড়ের দাবি করা হয়েছিল ক্যাবসহ বেশকিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। 

তবে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না থাকলেও মুড়িতে এবারের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাই প্যাকেটজাত মুড়ির দাম কমতে পারে। উৎপাদন পর্যায়ে মুড়ির ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় এটি ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে কমবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার বিষয় গুরুত্ব দিয়েছেন। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি আয় প্রাক্কলনের ফলে ঘাটতিই থেকে যাচ্ছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

অবশ্য বাজেটে আয় বাড়ানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঝুঁকিমুক্ত রাখার দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। এজন্য করমুক্ত আয় সীমা না বাড়িয়ে আয়কর থেকে আরও বেশি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হলেও এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। কমানো হয়েছে রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগের সীমা। দুর্দিনের ভরসায় ও আয়কর কিছু ছাড় পেতে মধ্যবিত্ত সঞ্চয় করে থাকে। এক্ষেত্রে মোট আয়ের ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ কর রেয়াতযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করা হতো, এবার তা করা হয়েছে ২০ শতাংশ। 

মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসৃজন, অবসর ও পারিবারিক ভাতা এবং অন্যান্য খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত হলেও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অতিদরিদ্রদের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি ১৫ টাকা করা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি বিবেচনায় এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয় নিম্নআয়ের মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। 

দেশে বাজেট ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। বাজেট বাস্তবায়নে বরাদ্দের অর্থ সঠিক সময়ে পৌঁছানো এবং বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহারে প্রতি খাতে বাড়াতে হবে দক্ষতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা। রোধ করতে হবে দুর্নীতি ও অপচয়।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না দেশে বাজেট ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। বাজেট বাস্তবায়নে বরাদ্দের অর্থ সঠিক সময়ে পৌঁছানো এবং বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহারে প্রতি খাতে বাড়াতে হবে দক্ষতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা। রোধ করতে হবে দুর্নীতি ও অপচয়। কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে।

এর মধ্যেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ক্রমাগত খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণকেই আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবারই বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কৃষি খাতের উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। তুলনামূলক অধিক জনসংখ্যার পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতার কারণে চলতি অর্থবছরে খাদ্যশস্যের বাজার নিয়েও রয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীলতা ফেরাতে জোর দেওয়া হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধির ওপর। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে দেশে এক কোটি টনের বেশি খাদ্য আমদানি করতে হবে। 

বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে একসময় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যদিও গত কয়েক বছরে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। গম, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডালের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কমবেশি ৯০ শতাংশ আমদানি নির্ভর।

চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায়ও দেশের খাদ্যশস্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে আছে। বাজেটে খাদ্যশস্য আমদানি খাতে শুল্ক-কর হারের পুনর্বিন্যাস ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। কারণ খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতার ফলে বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্যে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির ধারা শিগগিরই পরিবর্তন হবে না। তাই বাজেটে সরকারি উদ্যোগে আমদানি ও সরকারি মজুদের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রকৃত কৃষকদের নীতি সহায়তা দেওয়ার ওপর জোর দিতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশকেও খাদ্যের বাফার স্টক গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল জুড়েই খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওঠানামা ছিল। তবে বছরের শেষ প্রান্তে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্য, পানীয় ও তামাকের সমন্বিত মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেখান থেকে ক্রমে বেড়ে গত ডিসেম্বরে তা দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশে।

দেশের ভোজ্যতেলের বাজার প্রায়ই অস্থির থাকেরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার হিড়িক লেগেছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে আমদানি নির্ভর দেশগুলো। বাজেটে এর প্রতিফলন না থাকলে আগামী অর্থবছরে খাদ্য নিরাপত্তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। 

বৈশ্বিক গমের বাজারের ২৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টা উৎপাদনেও দেশ দুটির অবস্থান সামনের সারিতে। যুদ্ধের কারণে দেশ দুটি থেকে রপ্তানি এখন এক প্রকার বন্ধ। যুদ্ধের আগে দুই দেশই ছিল বাংলাদেশের আমদানিকৃত গমের বড় উৎস। চলমান সংকটে দীর্ঘমেয়াদে বিষয় নিয়ে বড় শঙ্কায় আছেন সবাই।

২০২১ সাল জুড়েই খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওঠানামা ছিল। তবে বছরের শেষ প্রান্তে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্য, পানীয় ও তামাকের সমন্বিত মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ।

সরকারি বিভিন্ন সূত্র মতে, দেশে প্রায় ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা থাকলেও সাত-আট লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। ২৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের মধ্যে ২২-২৩ লাখ টনই আমদানি নির্ভর। ১৮-২০ লাখ টন চিনির চাহিদার প্রায় শতভাগই এখন আমদানি হচ্ছে।

অন্যদিকে দেশে চালের চাহিদা আড়াই কোটি টনের বেশি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে হাওরে বন্যার কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় ১৫-২০ শতাংশ চাল আমদানি করতে হবে। এজন্য বাজেটে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন, আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা রাখা প্রয়োজনে শুল্কছাড়, ভর্তুকিসহ ডলার সংকট মেটানো দরকার। বাজার ঠিক রাখতে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বাজেটে আমদানিতে শুল্কহার কমানো জরুরি।  

খাদ্যের বেলায় চ্যালেঞ্জ মূলত দামে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজার থেকে কম দামে পণ্য ক্রয়ের চেষ্টা করা কঠিন। তাই শুল্ক কাঠামোকে সরলীকরণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা সহজ। ভারতসহ বিভিন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশগুলো শুল্ক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে।

পাশাপাশি অতি জরুরি খাদ্যপণ্যের বেলায় বন্দর ও কাস্টমস চার্জ কমানো বা মওকুফের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের দাম অন্তত ছয় মাস স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। খাদ্যের ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণই মূল সমস্যা। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে স্থানীয় বাজারে।

এছাড়া বিনিময় হারও কম সমস্যা নয়। এর কারণে অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্যের দামে। আবার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কারণেও দাম বাড়ার জন্য দায়ী।

সরকারকে অবশ্যই টিসিবির মাধ্যমে আমদানি ও সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করে বাজারে চাহিদার চাপ কমানোয় উদ্যোগী হতে হবে। দরকার হলে নিয়মিত শুল্ক সমন্বয় করতে হবে। আর কর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রম বাড়িয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

এখন ধানের ভরা মৌসুম চলছে। ফলে চালের দাম হাতের নাগালে থাকার কথা। কিন্তু বাজারে সেই চিত্র দেখা যায়নি। বরং কয়েকদিন ধরে দাম বাড়ছে। কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ থেকে ১২ দিনের ব্যবধানে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা এবং মোটা চালের কেজিতেও ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ মজুত ঠেকাতে মাঠে নেমেছে সরকার। এদিকে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম বেড়েছে। আকিজ, সিটি, এসিআই, স্কয়ার, বসুন্ধরা, প্রাণ-এই ৬টি গ্রুপের কাছে অতিরিক্ত চাল মজুত পাওয়া গেছে।

যেসব কোম্পানি প্যাকেটজাত চাল বিক্রি করবে, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল কিনতে পারবে না-এমন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। মন্ত্রী হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, এছাড়া গুদামে অতিরিক্ত চাল পাওয়া গেলে সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে এবং গুদাম সিলগালা করা হবে। প্রয়োজনে খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালে রাখতে সরকারি উদ্যোগে মজুদকৃত পণ্য খোলাবাজারে ছাড়তে পারে, সেই সঙ্গে পণ্য পৌঁছানোর আওতা বাড়াতে পারে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)