দেশ-বিদেশে কুচক্রী মহলের সমস্ত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধুম্রজাল ভেদ করে দিগন্ত বিস্তৃত কীর্তিনাশার বুক চিরে পারাপারের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে সগৌরবে দৃশ্যমান আমাদের কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু।

এটি এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব যা আমাদের সাহসিকতা ও সক্ষমতার একটি মূর্ত প্রতীক। দেখে মনে হচ্ছে, এটা যেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহীর ভাষায় বিশ্ববাসীকে বলছে,

‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির!’

পদ্মা সেতু তৈরির পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও হার না মানা সাহসী সিদ্ধান্তের ফলেই এটি স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে।

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে (২০১৮ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী) নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু আগামী ২৫ জুন ২০২২ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধন ঘোষণা করার পর ২৬ জুন সকাল থেকে যানবাহন যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে এটা জনসাধারণ ও পণ্য পরিবহন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুয়ারও উন্মোচন করে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ, পদ্মায় এবার উন্নয়নের ঢেউ উঠবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশের জিডিপি ১.২৩ শতাংশ বাড়বে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষা মতেও দেখানো হয়েছে যে, পদ্মা সেতু আঞ্চলিক জিডিপি ৩.৫ শতাংশ এবং দেশজ জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

১৯৩৬ সালে ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পদ্মানদীর মাঝি’ গল্পে নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে ও মাঝিদের যে জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাতে তাদের দীনহীন অসহায়ত্ব, আর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই দৃশ্যমান। যদিও গল্পের সাথে বাস্তবের মিল থাকে না, তথাপি গল্প তো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি হয়।

যাই হোক, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পেরিয়ে পাকিস্তানি হানাদার শাসন এবং অতঃপর, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে। এভাবে অনেকদিন পেরিয়েছে, পদ্মা পাড়ের লোকজনেরও বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তথাপি, পদ্মার বিস্তীর্ণ দুই পাড়ের সাথে সড়ক যোগাযোগ না থাকায় আশাতীত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। তাই, পদ্মা সেতু তৈরির পেছনে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের পাশাপাশি শক্তিশালী আঞ্চলিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নকেও সমান গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

২০১০ সালের নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক সেতু নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মৌনসেলের সমীক্ষায় সেতুর সুবিধা-খরচের অনুপাত ১.৭ গুণ এবং অর্থনৈতিক অভ্যন্তরীণ ফেরত হার ১৮ শতাংশ দেখানো হয়েছে যা সাধারণত কোনো বিনিয়োগের মানসম্মত ফেরত হার (১২ শতাংশের) চেয়েও অনেক বেশি। যার ফলে, গাণিতিক হিসাবেও এই সেতু যে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

সেতু বিভাগ দ্বারা নিযুক্ত যৌথ পরামর্শদাতা সংস্থার (আরপিটি-নেডকো-বিসিএল) সমীক্ষা অনুসারে, পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশের জিডিপি ১.২৩ শতাংশ বাড়বে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষা মতেও দেখানো হয়েছে যে, পদ্মা সেতু আঞ্চলিক জিডিপি ৩.৫ শতাংশ এবং দেশজ জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সময় কমে যাবে প্রায় ২-৪ ঘণ্টা (যদি যানজট না থাকে) এবং ঐ জেলাগুলোতে প্রসার ঘটবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের।

পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, টোল থেকে প্রাপ্ত অর্থে ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণ ব্যয় উঠে আসার কথা।

কৃষকেরাও পাবে পণ্যের ন্যায্য দাম‌। ফলে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া, চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে সাথে যুক্ত হবে এবং আগামী বছর রেল সেতুর কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে এটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সাথেও সংযুক্ত হবে। ফলে, ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য আরও সহজ ও দ্রুত হবে।

সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২৯,৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সেতু বিভাগ যা ৩৫ বছরে ১ শতাংশ সুদে (সুদসহ মোট ৩৬ হাজার কোটি টাকা) বছরে ৪ কিস্তিতে মোট ১৪০টি কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, টোল থেকে প্রাপ্ত অর্থে ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণ ব্যয় উঠে আসার কথা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকাশিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে সেতু পারাপারে বিভিন্ন রকম যানবাহনের জন্য যে টোলের হার নির্ধারণ করা হয়েছে তা যৌক্তিক নয়। এমনকি, বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় অনেক বেশি।

আবার অন্যদিকে, ফেরি চলাচলের টোলও প্রায় দেড় গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দ্রব্যসামগ্রীর দামও বেড়ে যাবে। ফলে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধির কথা আশা করা হচ্ছে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এডিবির এটির সমীক্ষা মতে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ২৪,০০০ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে গড়ে ৬৭,০০০ যানবাহন চলাচল করবে। সেতু দিয়ে এত বিশাল সংখ্যার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধির কারণে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।

যানজটের কারণে এই সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে অতিরিক্ত সময় ও জ্বালানি দুটোই লাগবে। কাজেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদ্মা সেতুর কারণে অতিরিক্ত যে যানজট সৃষ্টি হবে তা নিরসনের জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায়, যানজটে সময় নষ্ট করে ও অধিক জ্বালানি পুড়িয়ে যাত্রী বা পণ্যবাহী যান উচ্চ টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে চাইবে কি না তা ভবিষ্যতই বলে দিবে!

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়