একের পর এক এলাকায় শিক্ষক নিগ্রহের প্রতিবাদে সভা সমাবেশ হলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সবারই চাওয়া শিক্ষক নিগ্রহ ও হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে। বিষয়টি যত সহজ করে চাওয়া হলো, তারচেয়ে বাস্তবতা অনেক ভিন্ন।
সারা দেশেই অসংখ্য শিক্ষক মুখ বুজে অত্যাচার হজম করেন, নীরবে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করেন। অসুরক্ষিত ক্যাম্পাস, নিগ্রহকারীর অমিত ক্ষমতার পাশাপাশি দায়ী পারিপার্শ্বিক চাপ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষককেই দোষ সইতে হয়। বিশেষ করে হিন্দু শিক্ষক হলে তো কথাই নেই। শুরু হয় রাজনৈতিক চাপ, কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ট্রল। সাহস করে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও নানা চাপের মুখে তাদের একটা বড় অংশ মাঝপথে পিছু হটতে বাধ্য হন।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ, সমাজের উল্লাস এবং নিগ্রহকারীর পরাক্রম উপেক্ষা করে একজন হিন্দু শিক্ষকের পক্ষে বিচার চাওয়া এবং পাওয়া দুটোই জটিল। 

মুন্সিগঞ্জের স্কুল শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে মেরে ফেলা হয়নি। তবে নড়াইলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মানসিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর ঢাকার আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে তো পিটিয়ে হত্যাই করেছে তার ছাত্র। 

যে সরকারই দায়িত্ব নেয়, প্রতিশ্রুতি দেয় শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করা হবে। সেটা তো হয়নি উল্টো মৌলবাদী গোষ্ঠীর চারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে প্রত্যেক শিক্ষাঙ্গন। পরিস্থিতি ক্রমশ করুণ ও জটিল হচ্ছে। এর খেসারত দিচ্ছে দেশের শিক্ষাক্ষেত্র।

একদিকে যেমন ভালো শিক্ষকের আকাল, প্রভাবশালী ছাত্র এবং তাদের অভিভাবক ও মুরুব্বিদের দৌরাত্ম্যে যারা আছেন সেই শিক্ষকেরাও তটস্থ। বহু স্কুল কলেজে যেসব শিক্ষক সামলাচ্ছেন, তারা আর কাজটা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। কারণ এলাকার জনপ্রতিনিধি আর সমাজপতি নামের কিছু গোষ্ঠীর উৎপাত এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। 

যে সরকারই দায়িত্ব নেয়, প্রতিশ্রুতি দেয় শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করা হবে। সেটা তো হয়নি উল্টো মৌলবাদী গোষ্ঠীর চারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে প্রত্যেক শিক্ষাঙ্গন। পরিস্থিতি ক্রমশ করুণ ও জটিল হচ্ছে।

কখনো শিক্ষিকাকে কটু কথা বলা হচ্ছে তো কোথাও আবার ফেসবুকে মত প্রকাশের অপরাধে শিক্ষকের উপরে চড়াও হচ্ছে পড়ুয়ারা। হৃদয় মণ্ডল তো শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানের যুক্তি দিতে গিয়ে জেলে গেলেন। তাও কি না ছাত্ররাই ক্লাসের ভেতর তার কথা রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করেছে, বিক্ষোভ করেছে। ইন্ধন ছিল তারই সহকর্মী শিক্ষকদের। এর বাইরে দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘেরাও-নিগ্রহের পালা তো অন্তহীন। 

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই আকতার হোসেন আবার ওই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কারণ দর্শানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের এক ছাত্রের মোবাইলে স্ট্যাটাস নিয়ে এক সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আপনি ওই কলেজের একজন শিক্ষক। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরিশেষে দেখা যায়, আপনার উপস্থিতিতে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে বের করে আনা হয়।’ 

শিক্ষকতার নামে রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন বা আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোন পথে চলেছে তার একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় এই ঘটনায়। প্রায় প্রতিটি জনপদে সমাজবিরোধীরা জায়গা করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলে। 

এখন যা হচ্ছে এগুলো রোগের প্রকাশ মাত্র, গায়ে জ্বর আসার মতো। প্যারাসিটামল খেয়ে সাময়িকভাবে জ্বরের উপশম হয়, রোগ সারে না। নড়াইলের শিক্ষকের গলায় জুতার মালা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লেগেছে দশ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখে এখন দুই একজন গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। অথচ ঘটনা ঘটেছে পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তাদের সামনে।   

সমস্যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকায়। কোনো নিগ্রহকারীর সাজা হয় না। শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া দেখলাম, গলায় জুতার মালা দেখলাম, খুন দেখলাম, গালাগালি তো দেখছিই। দেখে মনে হচ্ছে হয়তো পুরো জাতি পড়ালেখা ছেড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়ে অতি স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় হুমকির মুখে পড়ছে দেশের ভবিষ্যৎ, শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী।  

নড়াইলের শিক্ষকের গলায় জুতার মালা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লেগেছে দশ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখে এখন দুই একজন গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। অথচ ঘটনা ঘটেছে পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তাদের সামনে।

মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত। মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদা অদৃশ্য। শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ যে স্তরে নেমে গেছে তা দেখে আতঙ্কিত হতে হয়। সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে আমাদের সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করেছে তা দেখে আজ সবাই হতাশ।  

কিন্তু এই অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় একদিনে ঘটেনি। কবে পরিস্থিতি শোধরাবে আমরা জানি না। দেশে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চাপে আমাদের প্রজন্মের হয়তো কেউই থাকবেন না। আজ একজন মার খেল, কাল অন্য কেউ খাবেন।

ছাত্ররা ফেল করলে শিক্ষক মার খাবেন, অন্য যেকোনো কারণে মার খাবেন। এমন এক পরিস্থিতি থেকে সকলেই প্রতিকার চায়। এখনো হয়তো সময় আছে কিশোর বয়সীদের মানসিক বিকাশে, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার। কিন্তু করবে কে? 

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন