সিলেট, সুনামগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের দেশের প্রায় ১১ জেলায় বন্যায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। পানিবন্দি এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার এবং আশ্রয়ের অভাবে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যায় মানুষ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার, হাসপাতাল বন্ধ। বিমান, রেল, মহাসড়কসহ সকল ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ইত্যাদি সেবা প্রায় বন্ধ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পুরো নগরী তলিয়ে গেছে।

পাহাড় ধস বেশকিছু প্রাণহানিও ঘটেছে। তবে পানি নামার সুখবর আসলেও বসতি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা চিকিৎসার সংকটের পর বেঁচে থাকার নিত্যপণ্যের বাজারে চরম ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। এর বাইরে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার পানি বাড়ছে। বন্যাকলিত এলাকায় এমনিতেই অনেক খাদ্যপণ্য পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার মানুষের বাড়িতে যে খাদ্য ছিল, তা-ও ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই।

সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তাও খুবই অপ্রতুল। ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগে যেভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল তা-ও সেভাবে হচ্ছে না। একটা সময় দুর্যোগ কবলিত মানুষকে সহায়তার হাত বাড়াত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো। কিন্তু সিলেটের বন্যায় সেই ধরনের উদ্যোগ দেখা মিললেও তার সংখ্যা ক্ষীণ।

অনেকেই এই সংকটের জন্য বৈশ্বিক অর্থনীতিকে দায়ী করলেও ভূরাজনীতির অনেক কিছুই দায়ী বলে মনে করছেন। আর এমন পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে নিত্যপণ্যের চড়া দাম। বন্যাকবলিত এলাকায় বাজার ঘুরে দেখা গেছে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডাল, চিড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে।

পাহাড় ধস বেশকিছু প্রাণহানিও ঘটেছে। তবে পানি নামার সুখবর আসলেও বসতি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা চিকিৎসার সংকটের পর বেঁচে থাকার নিত্যপণ্যের বাজারে চরম ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস।

সিলেট-সুনামগঞ্জের বাজারে সব পণ্যের মূল্য উচ্চ। আবার উত্তরাঞ্চলের বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সবজির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এদিকে পুরো দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দামের পাগলা ঘোড়া থামাতে শুল্কছাড়, বাজার তদারকি, আমদানির উদ্যোগ-এসব কোনো কিছুই কাজে আসছে না।

বন্যা, বিশ্ববাজার ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া—এমন সব রকমারি ছুতোয় একের পর এক বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। কেউ পণ্য কিনছেন আগের চেয়ে কম। কেউ কেউ খরচের চোটে পুরো পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। তাই ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকেরা বারবার বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সংকটকে পুঁজি করে আমাদের ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের পকেট কাটেন। এজন্য অনেকে বলে থাকেন, সংকটগুলো ‘কারো জন্য পৌষ মাস, কারো জন্য সর্বনাশ।’ বন্যা-সাইক্লোন ও মহামারির সময়ে কিছু নীতিহীন অসাধু ব্যবসায়ী অমানবিক আচরণ করে থাকেন।

গণমাধ্যমের কল্যাণে সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যায় বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ৫০ টাকার নৌকার ভাড়া ৫০ হাজারে, ১০ টাকার মোমবাতি ১০০ টাকায়, ৫০ টাকার পাউরুটি ৫০০ টাকায় হাঁকার খবরে মানুষের বিবেক কোনো ভাবেই নাড়া দেয়নি। ঠিক এভাবে দুর্গত মানুষকে চরম বিপদে রেখে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার ঘটনা পুরোনো নয়।

করোনার লকডাউন চলাকালেও কিছু মানুষ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটের পাশাপাশি ক্লিনিক ও হাসপাতালে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের দৃষ্টান্তও কম নয়। আর এই সমস্ত ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসী ও অমানবিক মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে। তারা একটুখানি সুযোগ পেলেই এই সন্ত্রাসে নেমে পড়েন। তাদের এই অমানবিক আচরণকে ঘৃণা জানানো ছাড়া সাধারণ মানুষর পক্ষে আর কিছুই করার থাকে না।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে একশ্রেণির অসাধু গুটিকয়েক ব্যবসায়ী মানুষের সংকটকে পুঁজি করে জনগণের পকেট কেটে কোটিপতি হওয়ার বাসনায় উন্মাদ হয়ে যান। তখন মানবতা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।

সেই কারণে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের তথ্যমতে, বিশ্বে করোনা মহামারিকালে ধনী ব্যবসায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে করোনা মহামারিকালেও জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা ও অগ্নিমূল্য, ক্লিনিকে চিকিৎসায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ অক্সিজেন সিলিন্ডারের অগ্নিমূল্য আদায়ের বিষয় জাতি এখনো ভুলতে পারেনি।

বন্যা বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সংকটকালীন সময়ে ব্যবসায়ীসহ সমাজের বিত্তবানেরা অসহায় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দানসহ সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় ত্রাণ বিতরণের প্রতিযোগিতাও থাকেন।

আবার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতারা সংকটকালীন সময়ে মানুষের পাশে থাকার জন্য ব্যবসায়ীদের আহ্বানও জানান। তবে বাজার ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের অনেকেই এভাবে মানুষের সংকটকে পুঁজি করে জনগণের পকেট কাটার উৎসব বন্ধ করে সহনীয় মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখলেই দুর্গত মানুষের প্রতি সুবিচার করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে একশ্রেণির অসাধু গুটিকয়েক ব্যবসায়ী মানুষের সংকটকে পুঁজি করে জনগণের পকেট কেটে কোটিপতি হওয়ার বাসনায় উন্মাদ হয়ে যান।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেই দেশে বাজার তদারকি, বিকল্প উপায়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হলেও বন্যা উপদ্রুত এলাকায় তার পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ বন্যার কারণে মানুষের চলাচল, খাদ্যপণ্য পরিবহনসহ স্বাভাবিক সব কিছুই বিপন্ন। সেখানে সরকারের লোকজন বাজার তদারকি অথবা স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগ স্বাভাবিক ভাবে করা কঠিন। আর এই সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির মূল্য সন্ত্রাসী মানুষের পকেট কাটার উৎসবে মাতোয়ারা হন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক খবরে জানা যায়, ঢাকার একটি বাজারে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য চিড়া ক্রয় করতে গিয়ে একজন ক্রেতা একবস্তা ২১শত টাকায় কিনলেও পরের দিন ২৯শত টাকা দাম চাওয়ায় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বন্যা দুর্গত এলাকায় এই সেবাটি দ্রুত পাওয়া কঠিন। সেখানে স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্যার কারণে বন্ধ আর সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতো আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সামর্থ্যও সেভাবে জেলা পর্যায়ে নেই। আর একারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগগুলো নিয়ে থাকে।

তাই ভোক্তা হিসেবে ব্যবসায়ীদের কূটকৌশল বুঝে পণ্য ক্রয়ে ভোক্তাদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। ঐসময় ভোক্তা হিসেবে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। প্রয়োজনে মাসের বাজার বাদ দিয়ে সপ্তাহের বাজার করা।

দাম বাড়লেই ঐ পণ্য ক্রয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া দরকার। দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের পণ্য মজুদের পরামর্শ দেন। এটা আমলে নেওয়া উচিত নয়। দাম বাড়লে ব্যবসায়ীদের লাভ বাড়ে, আর সে আরও বেশি লাভের আশায় ক্রেতাদের মজুদ করতে বলে এবং নিজেরাও মজুদে মনোযোগী হন।

এই সময়ে সরকার সরবরাহ লাইন ঠিক আছে কি না তদারকি জোরদার করতে পারে। বিকল্প উপায়ে বাজারে জোগান বাড়াতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো কর্মসূচি, টিসিবির মাধ্যমে বিক্রির মতো বিকল্প উপায়গুলো জোরদার করতে পারে।

যেকোনো পূজা, পার্বণ, ঈদ উৎসব, বন্যা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সংকটের সময় আমাদের ব্যবসায়ীরা যেভাবে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ে একযোগে সোচ্চার হন তা কতটুকু নৈতিক, মানবিক ও যুক্তিসংগত?

আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে পণ্যমূল্যের দাম একযোগে বাড়ালেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পরে আমার উল্টো সুর ‘বেশি দামে কেনা’ এ সমস্ত বিষয়গুলো কোনো ধরনের মানবিক ও নৈতিকতাপূর্ণ।

তাই সাধারণ ভোক্তাদেরকে সংকটকালীন সময়ে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে সংকটাপন্ন ও বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে মানবিক সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে ব্যবসায়ীক নীতি ও নৈতিকতা মেনে লাভ করে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, করপোরেট হাউসসহ দেশের বিত্তবানরা বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেন। তাহলেই মানবতার জয় হবে। যদি তা না হয়, তাহলে ‘ডাকাতি করে, অন্যদের মাঝে বিতরণের মতো ঘটনার দৃষ্টান্ত হবে।’

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)