ছবি : সংগৃহীত

পুঁজি বড় ভয়ঙ্কর। ব্যক্তিকে বস্তু করে তোলে। ব্যক্তি প্রথমে খুব খুশি, মহা আনন্দে আপ্লুত; কেননা সে বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠেছে। নিজের বিক্রয়মূল্য, সেভাবে এক সময় আকাশ ছোঁবে। স্বপ্ন বিভোর হয় সে।

স্বপ্নে ভাসে আকাশে। কিন্তু এই ভাবনাতেই তার মোহভঙ্গ ঘটে যখন সে দেখে একদিন তার বিক্রয়মূল্য প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। এটাই পুঁজিবাদের খেলা, মানুষকে নিয়ে।

মানুষ যতক্ষণ মানুষ থাকে তখন সে অমূল্য, যখনই সে বস্তুতে, দ্রব্যতে, সামগ্রীতে, পণ্যে পরিণত হয় তখনই তার দর উঠানামা করে। পতনও ঘটে।

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী? 

বাজার সংস্কৃতি ব্যক্তিকে এভাবেই কেনাবেচা করে। ফলে যে যত বেশি বিক্রি হবে, ব্যবহৃত হবে, তার ‘ডিমান্ড’ ততবেশি কমতে বাধ্য-একটা পর্যায়ে।

নায়িকা বা মডেলরা পণ্য হয়ে উঠতে চায়। মনে করে বাজার চাহিদা বাড়ছে। বাজার চাহিদার জন্য সে যেকোনো কিছু করতে রাজি, রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠে। মনে রাখতে হবে পণ্যের বহুল ব্যবহার পণ্যের আবেদন কমায়।

বাজারে নতুন ব্যান্ড আসে। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিউ লুক। নিউ ব্র্যান্ড। নিউ ট্রেন্ড। বাজার এভাবেই চলে, এটাই মার্কেট ট্রেন্ড-বাজার সংস্কৃতি।

বাজারে নতুন পণ্য এসে পুরোনো পণ্যকে সরিয়ে দেয়। জোরালো মার্কেটিংয়ে পুরোনোর পরিধি কমে যায়। কখনো কখনো পুরোনো বাজারও হারায় পুরোপুরি। এর পুরোটাই খেলা, বিনিয়োগ, বাজার, চাহিদা সবই পুঁজির।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা

নায়িকাদের ট্র্যাজেডি হচ্ছে তারা খুব কমই অভিনেত্রী হয়ে উঠেন, শিল্পী তো আরও কম। শিল্পী হয়ে উঠার জন্য যে শ্রম, অধ্যবসায়, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের একটা পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাতে হয় তাতে অনীহা প্রায় সকলের।

ফলে শিল্পী না হয়ে, অভিনেত্রী না হয়ে, কেবল নায়িকা হয়ে টিকে থাকতে পারেন না তারা বেশিদিন। নায়িকার সময়কাল বড় সীমিত। হয়তো ওভারনাইট তারকা হয়ে যাচ্ছেন, আইটেম হচ্ছেন, ভাইরাল হচ্ছেন। কিন্তু পতনও ঘটছে রাতারাতি।

পুঁজি আর পণ্যের হিসাব করলে সানি লিওনের চেয়ে বড় সেলিব্রেটি, বড় তারকা, বড় নায়িকা আর কেউ নন। উৎকট পুঁজির উৎপাদন সানি লিওন কিন্তু খুব অল্প দিনেই বাজার হারিয়েছিলেন। তারকা পতন—সানির কী আর এখন বাজার আছে, যে বাজার তার পেছনে বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংক উজাড় করার মতো করে।

আমাদের একটি দার্শনিক দারিদ্র্য রয়েছে। আমরা নিরীক্ষা প্রবণ হয়ে কোনো ঘটনাকে দেখি না। তল থেকে খুঁজি না, ফলে উপরি কাঠামোতে যা দেখা যায় তা নিয়ে হুজুগে মাতি। নায়িকাদের বিয়ে আমাদের বিনোদনের খোড়াক হয় বলে পেছনে যে হতাশা, গ্লানি আর ব্যক্তি পরাজয়ের বোধ সাব-কনসাস লেভেলে বুদবুদ আকারে ক্রিয়াশীল, ভাসতে থাকে, তা কে দেখে?

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সিনেমা কেন মানসম্মত না

বিয়ে একটি সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি প্রক্রিয়া। কেউ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেন, নাও পারেন। আবার একাধিকবার নিজেকে যুক্ত করতে পারেন। সেটি তার স্বাধীনতা, আমার কনর্সান নয়।

আমার কনর্সান হলো, লক্ষ্য করে দেখবেন, নায়িকাদের বেশিরভাগ বিয়ে তাদের নায়িকা হওয়ার আগে। অথবা নায়িকা অধ্যায় যখন প্রায় সমাপ্ত অনেকটা তখন। আর নায়িকা জীবনের আগের বিয়েগুলো প্রায় সবই গোপন। নায়িকা থাকাকালীন বিয়ের কোনো সুযোগই নেই অনেকটা এমন। 

লক্ষ্যযোগ্য বিষয় হলো, একঝাঁক নায়িকা যাদের আর হাতে কাজ নেই, তারা অনেকেই বিয়ের শর্তে নিউইয়র্ক প্রবাসী হয়েছেন। অনেকে আরও অন্যান্য দেশেও স্যাটেলড।

যখন পুঁজির ভাষায় বাজার থাকে তখন তারা বিয়েকে গুরুত্ব দেন না বা সময় পান না। কিন্তু যখন তাদের ‘মার্কেট ডিমান্ড’ থাকে না, রেটিং কমে যায় তখন তারা আগ্রহী হন বিয়েতে। আরও বেশি বিস্ময় ও হতাশার বিষয় হলো, অনেকেই বিয়ে করে হিজাব পরে ছবি দিয়ে বলেন, ‘বিয়ের পর আর ছবি করব না।’

আরও পড়ুন : সালমান শাহ : চলচ্চিত্রের স্টাইলিশ আইকন

হিজাব ব্যক্তি স্বাধীনতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে কাজটি তিনি দীর্ঘদিন ধরে করেছেন তার প্রতি কি নিজেরও সম্মান আছে? যদি না থাকে তবে কাজটি করেছেন কেন এতদিন? শুধুই উপার্জনের জন্য? আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না এমন?

তবে কী বিয়েটা নায়িকাদের কাছে জীবিকা? কিংবা গ্রিন কার্ড পাওয়ার শর্ত? অন্যের ঘাড়ে ঝুলে বিলাসী জীবনযাপনের উসিলা? তাই যদি না হয় তবে পুঁজির ভাষায় যখন ‘পড়তি সময়’ তখন তারা বিয়েতে উপগত হতে চান কেন?

আসলে সমস্যা হলো, শিল্পী না হয়ে উঠা, ব্যক্তি থেকে বস্তু, পণ্য হয়ে উঠা। পণ্যের বাজার পড়ে যায়। কাটতি থাকে না। একসময় ফ্রি দিতে চাইলেও লোকে নেয় না।

কেউ যদি শিল্পী হয়ে উঠে তবে তার হয়তো কাটতি হবে না, বাজার পড়তিও হবে না। ধনাঢ্য বা প্রবাসী কাউকে বিয়ে করাটাই—তার একমাত্র জীবিকা হবে না হয়তো!

জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক, আজ সারাবেলা