ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের মানুষ অবেগপ্রবণ, সহজ-সরল, অতিথিপরায়ণ, একদম মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায় তাই। কাদামাটিতে গড়া মানুষ। আসলে কোন এলাকার মানুষ কেমন হবে, সেটা অনেকটা নির্ভর করে ভূ-প্রকৃতির ওপরও। আফ্রিকার মানুষের ধরন আর আরবের মানুষের ধরন, জীবন-যাপন, পোশাক-আশাক এক রকম নয়, হবেও না।

এই বাংলাদেশেই পাহাড়ের মানুষ যতটা পরিশ্রমী, সমতলের মানুষ ততটা নয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের উদার প্রকৃতি, এই অঞ্চলের মানুষের মানস গঠনেও ঔদার্য এনেছে। এই অঞ্চলের মানুষের মনের ভেতরে সুফি বা বাউলদের হৃদয় রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এই সারল্য, এই ঔদার্য মুগ্ধ করে সবাইকে।

বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন, তারা সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতার কথা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে। সাধারণ মানুষের উষ্ণতা, আতিথেয়তা, সারল্যতা কেউ ভুলতে পারেন না।

আরও পড়ুন : ভোটের গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার

বাংলাদেশের অনেক ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে পড়তে যায়। তাদের অনেকেই সেখানে বিয়ে করেন। কেউ কেউ বিদেশি বউ বা স্বামী নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, অনেকে সেখানেই সংসার পাতেন। বাংলাদেশের কেউ কেউ বিদেশে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে বিদেশি বিয়ে করেন। তবে বেশিরভাগই প্রেম করে সংসার পাতেন। বাংলাদেশি মানুষের ভালোবাসার টান উপেক্ষা করা যে-কারও জন্যই কঠিন।

ইদানীং আরেকটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, প্রেমের টানে বিদেশিদের ছুটে আসার খবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্ব সত্যি সত্যি একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে।

এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন, মানে সবাই সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। এভাবেই গড়ে ওঠে প্রেম। সেই প্রেমের টানে বিদেশিরা ছুটে আসেন বাংলার অজপাড়াগাঁয়। কেউ কেউ এখানেই সংসার পাতেন। কেউ বাংলাদেশের স্বামী বা স্ত্রী নিয়ে ফিরে যান নিজের দেশে।

আরও পড়ুন : অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ 

তবে নিছক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রেম অনেক সময় টেকে না। দুই পক্ষের সামাজিক, আর্থিক, সংস্কৃতিগত আকাশপাতাল ব্যবধান দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের প্রেমের টান উপেক্ষা করা সহজ হয় না।

ইদানীং আরেকটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, প্রেমের টানে বিদেশিদের ছুটে আসার খবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে বিশ্ব সত্যি সত্যি একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এই যে বাংলাদেশের মানুষের এত মানবিক গুণ, তাদের অন্তরে এত প্রেম; তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা এমন কেন। যার অন্তরে প্রেম আছে সে তো মানুষকে যেমন ভালোবাসবে, দেশকেও ভালোবাসবে। আমরা মুখে মুখে দেশপ্রেমের কথা বলি, জাতীয় সংগীত গেয়ে কেঁদে বুক ভাসাই তাহলে দেশটার চেহারা এত মলিন কেন?

দেশের চেহারা মলিন হলে তো আমাদের নয়ন জলে ভাসার কথা। তাহলে তো দেশের চেহারা উজ্জ্বল করার জন্য আমাদের সবার মিলে কাজ করার কথা। কিন্তু চারপাশে তাকালে দেশটা মলিনই লাগে। প্রকৃতি এমন উদারভাবে আমাদের দিয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা ঠিকমতো রক্ষাও করতে পারি না।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশে কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন

আমরা বলি নদীমাতৃক বাংলাদেশ। কিন্তু হিসাব করে দেখুন, ৫০ বছরে কত নদী আমরা দখল করেছি, কত নদীকে মেরে ফেলেছি, কত নদীকে খাল বানিয়ে ফেলেছি। ঢাকার কথাই ধরুন, একসময় ঢাকার বুকে জালের মতো বিছানো ছিল খাল। তার বেশিরভাগই এখন স্মৃতি।

খাল দখল করে রাস্তা বানানো হয়েছে। যাও দুয়েকটি খাল আছে, সেগুলোতে আগের মতো নৌকা চলা তো দূরের কথা, পানি প্রবাহের ব্যবস্থাও রাখিনি। পুরোটাই ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছি।

ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। কিন্তু ঢাকার চারপাশে রয়েছে চারটি মিঠা পানির নদী—বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু। ধলেশ্বরী খুব দূরে নয়। সৃষ্টিকর্তার এমন আশীর্বাদ পাওয়া শহর বিশ্বেই কয়টি আছে। চারটি নদীবেষ্টিত ঢাকা হতে পারতো, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি। অথচ বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অবস্থান বরাবরই নিচের দিকে।

যে নদীগুলো আমাদের আশীর্বাদ হতে পারতো, দখলে-দূষণে সেগুলোকে আমরা অভিশাপ বানিয়ে ফেলেছি। বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন মাছও বাঁচতে পারে না। চামড়া শিল্প ঢাকা থেকে সরিয়ে সাভারে নিয়ে আমরা ধলেশ্বরীকে হত্যার সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছি।

আরও পড়ুন : মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভূমিকা

আপনার উত্তরসূরি যদি আপনাকে প্রশ্ন করে, তোমরা না রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছ, তোমরা না দেশকে অনেক ভালোবাসো; তাহলে তোমরা কীভাবে খালগুলো দখল করে ঢাকাকে বাসের অযোগ্য করে তুললে, কীভাবে নদীগুলোকে মেরে ফেললে? আপনি কী জবাব দেবেন।

বাংলাদেশের সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। আর সেই প্রাণটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে থাকে। বিদেশি যারাই আসেন, তারাই বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন যানজটকে।

বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এক চিলতে ঢাকা এখন বাড়তে বাড়তে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারে ধাক্কা দিচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশনও ঢাকাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে ঢাকায় ২ কোটি লোকের বাস। ঢাকার কারওয়ানবাজারে প্রতিদিন যত লোক আসা-যাওয়া করেন, বিশ্বের অনেক দেশের জনসংখ্যা তারচেয়ে কম। জনসংখ্যার এই বিপুল চাপে ঢাকা ন্যুব্জ প্রায়।

বাংলাদেশের সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। আর সেই প্রাণটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে থাকে। বিদেশি যারাই আসেন, তারাই বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন যানজটকে। অতিরিক্ত মানুষ, অতিরিক্ত যানবাহনই যানজটের কারণ বটে। তবে আমাদের আইন না মানার প্রবণতা।

আরও পড়ুন : সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়

উন্নত বিশ্ব তো বটেই, পাশের দেশ ভারতেও মানুষ ট্রাফিক আইন মেনে চলে। আর ট্রাফিক আইন বলে বাংলাদেশে কার্যত কিছু নেই। কে, কার আগে যাবে তার প্রতিযোগিতাতেই যানজট বাড়তে থাকে। নিয়ম মেনে চললে যানজটেরও একটা মাত্রা থাকে। কিন্তু কারও কারও আগে যাওয়ার চেষ্টা, উল্টো পথে যাওয়ার চেষ্টা পুরো শহরকেই স্থবির করে তোলে।

যে ফুটপাত বানানো হয় মানুষের চলাচলের জন্য সেটা এখন মোটরসাইকেলের দখলে। আমরা দেশকে এতটাই ভালোবাসি, আমাদের ঠেকাতে ফুটপাতে ব্যারিকেড বসাতে হয়। যানজট এড়াতে হেঁটে গন্তব্যে যেতে চাইলেও আপনি নির্বিঘ্নে যেতে পারবেন না।

ফুটপাত হয় মোটরসাইকেলের দখলে, নয় নোংরা, কোথাও ফুটপাতেই পাবেন খোলা ম্যানহোল। এই শহরে হাঁটা যায় না, গাড়িতে চড়েও নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। এই শহরকে আমরা ভালোবাসি!

বাংলাদেশে সেবা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। পাসপোর্ট অফিসে যান, এনআইডি কার্ড অফিসে যান, জরিপ অফিসে যান, বিআরটিএতে যান, ব্যাংকে যান, ওয়াসায় যান, তিতাসে যান, হাসপাতালে যান—প্রাপ্য সেবা পাবেন না। পদে পদে ভোগান্তি, দুয়ারে দুয়ারে অনিয়ম।

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

টাকা দিয়ে আপনি যে সেবা কিনবেন, সেটা পেতেও আপনাকে উপরি দিতে হবে। পাশের টেবিলের যে সহকর্মী, আপনি অবসরে গেলে সেও সুযোগ পেলে আপনার পেনশনের ফাইল আটকে রাখবে। ঘুষ ছাড়া এখানে ফাইল নড়ে না, বদলি হয় না, পোস্টিং হয় না।

যে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখাবেন, তিনি ঢাকায় শিক্ষা অধিদপ্তরের এসে হাতে-কলমে শিখে যান, নৈতিকতা কত প্রকার ও কী কী।

সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গেলে ঋণ পায় না। পেলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সাধারণ মানুষের লাখ টাকার ঋণের কিস্তি আদায়ে ব্যাংকের যত আগ্রহ, শিল্পপতিদের কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ততটাই অনাগ্রহ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বছরে বছরে বাড়ে। সুযোগ পেলেই আমরা ব্যাংক লোপাট করে দেই। মুখে মুখে দেশকে ভালোবাসার কথা বললেও সুযোগ পেলেই টাকা পাচার করে দেই বিদেশে।

টাকা দিয়ে আপনি যে সেবা কিনবেন, সেটা পেতেও আপনাকে উপরি দিতে হবে। ঘুষ ছাড়া এখানে ফাইল নড়ে না, বদলি হয় না, পোস্টিং হয় না...

দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রডের বদলে বাঁশ, সিমেন্টের বদলে বালি দেওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ। আশপাশে কোনো রাস্তা নেই, জনবসতি নেই; মাঠের মাঝখানে একটা সেতু—এমন ছবি কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। বোঝাই যায় ইঞ্জিনিয়ার আর ঠিকাদারের টাকার চাহিদা মেটাতেই সেতু বানানো হয়েছে, মানুষের পারাপারের জন্য নয়।

এত যে সারল্য, এত যে প্রেম, এত যে সুফি-বাউলের হৃদয়; সাম্প্রদায়িকতার বিষ কিন্তু ছড়িয়ে গেছে অনেক গভীরে। কথায় কথায় আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বিনা দোষে বা একজনের দোষে আরেকজনের ঘরে আগুন দিতে আমাদের একটুও বাধে না। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি না। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র, জাতি আমাদের মাপকাঠি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন : রাজনীতিই শেষ ভরসা 

ফেসবুকে আমরা একেকজন বিশাল বিপ্লবী। কিন্তু বাস্তবে কোনো অন্যায়েরই প্রতিবাদ করি না। মুখ বুজে সয়ে যাই। কয়েকদিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী এক ছিনতাইকারীকে আটক করে। তা নিয়ে বিশাল আলোচনা। অথচ এমনটাই হওয়ার কথা।

আমরা সবাই যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম, তাহলে প্রিয় দেশটা এমন মলিন হতো না। নিজের গায়ে না আসা পর্যন্ত আমরা মুখ বুজে থাকি। এই যে আমাদের প্রেমের এত টান, সেই প্রেমের কিছুটা যদি দেশের জন্য রাখি, তাহলেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশ।

আপনি হয়তো ভাবছেন, আমার ছেলেমেয়ে তো কানাডা চলে যাবে, দেশ তবে গোল্লায় যাক। কিন্তু একবার ভাবুন, ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের সবাই তো বিদেশে চলে যেতে পারবে না। আপনার ছেলেমেয়ে চলে গেলেও আপনার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দেশেই থাকবে, ভাই থাকবে, মামা-চাচা-খালা-খালু থাকবে, আপনার বন্ধু থাকবে। তাই দেশটাকে বাসযোগ্য রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।

‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে চোখের জলে বুক ভাসানো দেশপ্রেম নয়। দেশপ্রেম হলো নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশের জন্য কাজ করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, দুর্নীতি বন্ধ করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায্যতা নিশ্চিত করা, গণতন্ত্র কার্যকর করা, সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেওয়া।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com