সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যে মানুষগুলো নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, শহীদ শেখ কামাল তাদের  মধ্যে অন্যতম।

মাত্র ২৬ বছরের জীবনসীমায় দেশ ও সমাজের জন্য যা করে গেছেন, তা নিছক কর্ম নয় বরং সেটি তরুণদের উজ্জীবিত হওয়ার মূলমন্ত্রও বটে। ক্ষণজন্মা এ মহীয়ান পুরুষের আজ ৭৩তম জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের আজকের এ দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সংসার আলোকিত করে পৃথিবীতে শুভ আগমন ঘটে শেখ কামালের।

একটি দেশের মহান স্থপতি তথা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান শেখ কামাল,  অত্যন্ত মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছাত্র ছিলেন, চাইলেই নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতেন ভালো লাভজনক পেশায় কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে পাড়ি জমাতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসব করেননি। দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকায়,জাতির পিতার সন্তান হিসেবে, পিতা মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ করে তিনি দেশ গড়ার দায়বদ্ধতা থেকে বাবার মতই দেশ গঠনে নিজেকে উৎসর্গ  করেছিলেন। যেমন-১৯৭৪ সালের বন্যার সময় রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে বন্যার্তদের সাহায্যে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন অগ্রগামী কর্মী।

শেখ কামাল নামটি উচ্চারিত হলেই জাতির পিতার মতোই তেজদীপ্ত আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয় বাংলার আকাশে বাতাসে। এতটাই সৎ, নির্মোহ ছিলেন যে, ২২- ঊর্ধ্ব এক উদ্দীপ্ত যুবক হয়েও মন্ত্রী-এমপি হননি বরং বাঙালির পরম বন্ধু ও মানবতার মূর্ত প্রতীক হয়ে সৎভাবে সংগ্রাম করে বেঁচে ছিলেন তিনি।

৭১- এর ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাতে পাকহানাদার বাহিনী যখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে, ঠিক সেই সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য কামাল ধানমন্ডির বাড়ি থেকে পাড়ি জমান রণাঙ্গনে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমজে ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেন। তরুণ বয়সে শুধু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং একজন তরুণের জীবন কতখানি কর্মময় হতে পারে তা শহীদ শেখ কামালের সংক্ষিপ্ত জীবন বিশ্লেষণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেওয়ার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা শহিদ শেখ কামাল। খেলাধুলার নতুন ধারা সূচনা করতেই ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ’আবাহনী ক্রীড়াচক্র’। শেখ কামাল ছিলেন খেলাধুলায় একজন নিবেদিত প্রাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন ফুটবল, আবাহনীর হয়ে খেলেছেন ক্রিকেট। মূলত ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলসহ সবধরনের খেলায় লাল সবুজের সাফল্যের বীজ তাঁরই হাতে বোনা। প্রতিটি খেলাকে তিনিই মানুষের কাছে এনেছেন।

দেশের রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও অত্যন্ত উদার ও সরলমনা ছিলেন শেখ কামাল। অহমিকা কিংবা দম্ভ ছিল না তার মধ্যে। ডিসিপ্লিন,অগাধ দরদ এবং মনোযোগে তিনি খেলাধুলা করতেন। এমনকি ‘খেলাপাগল শেখ কামাল’ তকমাও পেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পুত্র নয়, বরং মাঠের মানুষ হয়ে থাকতেই তিনি পছন্দ করতেন। এতটাই খেলাপ্রেমী ছিলেন যে, একজন স্বনামধন্য অ্যাথলেটকেই জীবনসঙ্গী করেছিলেন।

শেখ কামাল একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। ফুটবলের উন্নতির জন্য ৭৩-এ তিনি আবাহনীতে বিদেশি কোচ বিল হার্টকে নিযুক্ত করেন। ৭৫- এর ১৫ আগস্ট বাঙালি হারিয়েছিল তাদের পিতাকে আর আবাহনী হারিয়েছিল তাদের অভিভাবক শেখ কামালকে। শেখ কামাল বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের ফুটবল আরও ভালো করতে পারত, বিশ্বকাপেও আসন করে নিতে পারত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলার পতাকা উড়বে ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলার জন্য— এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল। বাংলাদেশ ক্রীড়াশক্তিতে অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার স্বপ্নও ছিল শেখ কামালের চোখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র শেখ কামাল অধ্যয়নের পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক জগৎটাকে তার পদচারণায় মুখর করে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধও করেছিলেন তিনি। বাংলার ক্রীড়া আন্দোলনে শেখ কামাল নিজেকে যেমনটি নিবেদিত রেখেছিলেন, ঠিক তেমনটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। পিতা বঙ্গবন্ধু নিজেই ছেলে শেখ কামালকে ছায়ানটে ভর্তি করে দেন। ছায়ানটে সেতার শিক্ষার তালিম নিয়েছিলেন শেখ কামাল। গানের গলাও ছিল দারুণ। পড়াশোনা, সংগীতচর্চা, বিতর্ক, অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে গতিশীল করতে মরিয়া ছিলেন শেখ কামাল। দেশ স্বাধীনের পর বন্ধুদের সহযোগে নাট্যদল ’ঢাকা থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। আধুনিক সংগীতের সংগঠন 'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’ তারই হাতে গড়া। শহিদ শেখ কামাল একজন সংস্কৃতিমনা সুকুমারবৃত্তির মানুষ ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালির সংস্কৃতি বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হবে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র অল্প বয়সে যা করে গেছেন, তা বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।

স্বাপ্নিক ও তারুণ্যের অমিত শক্তিতে বলিয়ান শেখ কামাল। পিতা মুজিবের সাহসী নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া দেশটি একদিন পৃথিবীর মানচিত্রে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সেই সোনালী স্বপ্নই তিনি দেখতেন।

সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, অদেশপ্রেমিক বাঙালি, পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা  বুঝে  গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের নেতৃত্বে  আসবেন শেখ কামাল। তা যেন না হয়, তাইতো প্রথমে তার  নামে অপপ্রচার করে এবং পরে তাকে হত্যার মাধ্যমে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে।

কী অপরাধ ছিল শেখ কামালের? কেন মিথ্যা, বানোয়াট অপপ্রচারের শিকার হতে হলো? কেন তাকে মিথ্যাচারে আঁকা ইতিহাসের খলনায়কের তকমা নিয়ে অকালে মরতে হলো? তিনি জাতির পিতার সন্তান বলে?

বাঙালি জাতির এ সূর্যসন্তানের বিরুদ্ধে পাকিপ্রেমী ও আওয়ামী লীগ বিরোধী এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা- বানোয়াট ভিত্তিহীন অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, যা বাঙালি হিসেবে মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। সাধারণ মানুষ হয়তো না জেনেই এসব মিথ্যা অপপ্রচার সত্যি মনে করে এসেছে। কিন্তু সঠিক তথ্য না জেনে, সঠিক ইতিহাস না জেনে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচার প্রশ্রয় দেওয়া অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। শেখ কামালের জন্মদিবস কিংবা মৃত্যুদিবসে ফেসবুক- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা জানানোই শেষ নয় বরং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সকল অঙ্গসংগঠনের উচিত তরুণ সমাজের এই আইডলের বর্ণিল কর্মময় জীবন, কর্ম প্রতিভা,ত্যাগ, দেশের প্রতি তার মমত্ব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

নতুন প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তির কুয়াশায় মোড়ানো শেখ কামালকে সঠিকভাবে জানতে হবে। শেখ কামালকে নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে হবে, সিনেমা তৈরি করতে হবে। তবেই না বিভ্রান্তি ঘুচে একজন সফল শেখ কামালকে জাতি জানতে পারবে।

বিপথগামী- বেপরোয়া তরুণ সমাজকে শেখ কামাল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাই মুক্তিযুদ্ধ শেষে এদেশের যুবক, তরুণ, কিশোরদের ভ্রান্ত পথ থেকে সরিয়ে মেধা মনন গঠন করতে তাদের এনেছেন খেলার মাঠে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ইদানিং যে বিষয়টি আমাদের চোখে বেশি আলোকপাত করে, তা হলো আমাদের দেশের তরুণরা বাইরের দেশের খেলোয়াড়, অভিনেতা, সংগঠককে আইডল মনে করে তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু আমরা যদি শেখ কামালকে অনুসরণ করতাম, হয়তো আরও গতিশীল হতো সমাজ, শৈল্পিক মহিমায় আরও উদ্ভাসিত হতো জীবন।

দেশ বিনির্মাণ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি এমনকি শিল্পসাহিত্যে শহীদ শেখ কামালের অসামান্য অবদান। তার  কর্মময় জীবন বাঙালির হৃদয় মণিকোঠায় চির অম্লান হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে চেতনা, অনুপ্রেরণা কিংবা পথদ্রষ্টা হয়ে, তারুণ্যের আদর্শ হয়ে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

লেখক : তরুণ কলামিস্ট, সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যাল