ছবি : সংগৃহীত

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যে বিশ্বাস সংস্কৃতি, ইতিহাস, কিংবদন্তি বা ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লাকি বা আনলাকি নম্বরে বিশ্বাসের ব্যাপারটিও তাই। একটা নির্দিষ্ট জাতির নির্দিষ্ট কিংবদন্তির কারণে একটি নির্দিষ্ট নম্বর লাকি বা আনলাকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আবার, স্রেফ উচ্চারণের কারণেই একটি নম্বর লাকি বা আনলাকি হয়ে যেতে পারে। ৪ (চার) নম্বরটির কথাই ধরা যাক। চীনে এটি আনলাকি নম্বর। কারণ, চীনা ভাষায় ‘৪’ ও ‘মৃত্যু’—এই শব্দ দুটির উচ্চারণ খুব কাছাকাছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জার্মানিতে ‘৪’ লাকি নম্বর!

১৯৫৬ সালে মনোবিজ্ঞানী জর্জ এ মিলার ‘দ্য ম্যাজিকেল নম্বর সেভেন, প্লাস অর মাইনাস টু’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে তিনি দাবি করেন, আমাদের চারপাশে ‘৭’ নম্বরটির ছড়াছড়ি স্রেফ কাকতালীয় ব্যাপার নয়; এর বিশেষ অর্থ আছে।

আরও পড়ুন : চীন যেভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হলো

মিলারের এই গবেষণাপত্র ‘লাকি সেভেন’ টার্মটিকে জনপ্রিয় করেছে কি না, নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশে ‘৭’ লাকি নম্বর।

অন্যদিকে, চীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে এটি আনলাকি নম্বর! এসব দেশে বছরের সপ্তম মাস হচ্ছে ‘ভূতের মাস’। আর ভূত, আর যা-ই হোক, লাকি হতে পারে না!

এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। ‘৮’ নম্বরটি চীন ও জাপানে লাকি, কিন্তু দক্ষিণ ভারতে আনলাকি; ক্যাথলিক ধর্মের যেকোনো দেশে ‘৩৯’ একটি লাকি নম্বর, আফগানিস্তানে যা আনলাকি হিসেবে বিবেচিত; ৬৬৬’ নম্বর খ্রিষ্টানদের কাছে দাজ্জাল তথা এন্টিক্রাইস্টের প্রতীক, যা চীনাদের কাছে লাকি; নম্বর ‘৩’ চীন ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশে লাকি, কিন্তু জাপান ও ভিয়েতনামে আনলাকি।

চীনা দার্শনিকরা ‘৩’ নম্বর তাদের বিভিন্ন লেখায় ব্যবহার করেছেন এন্তার। ইউরোপে বিশ্বাস করা হয় যে, যা কিছু ভালো তা তিনটি করে আসে। এক্ষেত্রে ‘থ্রি উইশ’ বা ‘তিনটি ইচ্ছা’-র কথা উল্লেখ করা যায়।

আরও পড়ুন : চীনের ‘তিন সন্তান নীতি’ এবং অতঃপর

জাপানে ও ভিয়েতনামে এই ‘৩’-ই ভয়ের নম্বর। এই দুটি দেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, তিন ব্যক্তি যদি একসঙ্গে ছবি তোলেন, তবে মাঝের জন্য শিগগিরই মারা যাবেন!

বৈশ্বিক কুসংস্কার সূচক অনুসারে, সবচেয়ে আনলাকি নম্বর হচ্ছে ১২, ১৭, ১৩ ও ৬৬৬। এগুলোর মধ্যে আবার ‘১৩’, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে, অর্জন করেছে ব্যাপক কুখ্যাতি।

ছোটবেলা থেকে বাংলাদেশেও আমরা ‘আনলাকি থার্টিন’ টার্মটি শুনে আসছি। যতদূর জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এই টার্মটির উৎপত্তি। বাইবেলের ইতিহাস বলে, লাস্ট সাপারে যীশুর সঙ্গে ছিলেন তার ১৩ জন শিষ্য। অনেকে মনে করেন, তাদের মধ্যে ১৩ নম্বর শিষ্য হলেন জুডাস। আর এই জুডাসই বিশ্বাসঘাতকতা করে যীশুকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সুতরাং ‘১৩’ আনলাকি নম্বর।

পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশে ‘১৩’ আনলাকি হলেও, ইউরোপের দেশ ইতালিতে কিন্তু এটি লাকি নম্বর! বিশেষ করে জুয়ার টেবিলে একে লাকি নম্বর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনেও ‘১৩’ লাকি নম্বর।

আরও পড়ুন : মহাশূন্যে চীনের তিন শতাধিক সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহ

চীনে ‘১৩’ নিশ্চিত সাফল্যের প্রতীক। এর কারণ, চীনা ভাষায় ‘১৩’ শব্দের উচ্চারণ আরেক চীনা শব্দ ‘নিশ্চিত জীবন’-এর উচ্চারণের খুব কাছাকাছি। ভারতেও ‘১৩’ লাকি নম্বর। হিন্দু সূত্র অনুসারে, মাসের ১৩ তারিখে কোনো কাজ করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

যাই হোক, সবাই জানেন চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে (সোলার টার্মস)। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে।

বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। ৭ আগস্ট থেকে এই দেশে শুরু হয়েছে ১৩তম তথা ত্রয়োদশ সৌরপদ।

দৃশ্যত, একটা ‘আনলাকি’ নম্বরের দিনে শুরু হয়েছে একটি ‘লাকি’ নম্বরের সৌরপদ। এই সৌরপদকে চীনা ভাষায় ডাকা হয় ‘লিছুয়ু’ বা শরতের শুরু। এর ব্যাপ্তিকাল ৭ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত।

নাম ‘শরতের শুরু’ হলেও, এই সৌরপদে কিন্তু গরম চরমেই থাকে। এই গরম সাধারণত ৩০ দিন স্থায়ী হয়। এই ৩০ দিনকে চীনারা ডাকে ‘শরতের বাঘ’ নামে। এই সময়কাল ‘ইন্ডিয়ান সামার’ নামেও পরিচিত।

আরও পড়ুন : চীনের দুই অধিবেশন

এসময় বৃষ্টিপাত কমে যায়, মানুষ প্রচুর ঘামে। একথা যে কতটা সত্য, তা আমরা যারা চীনে বাস করি, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন, এমনকি সন্ধ্যার পরও বাইরে গেলে ঘেমে বাসায় ফিরতে হয়।

লিছুয়ু সৌরপদের প্রথম দিনে চীনাদের মধ্যে, প্রাচীনকাল থেকেই, শরীরের ওজন মাপার প্রথা প্রচলিত আছে। আজও অনেকে এদিন নিজেদের ওজন মাপেন ও গ্রীষ্মের শুরুতে মাপা ওজনের সঙ্গে তার তুলনা করেন। যদি দেখা যায়, ওজন নাটকীয়ভাবে কমে গেছে, তবে তা পূরণের চেষ্টা করেন তারা। সেক্ষেত্রে শরতের শুরু থেকে তারা বেশি বেশি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার খেতে থাকেন। বিশেষ করে মাংস বেশি খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এসময়।

লিছুয়ু কৃষকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সৌরপদ। কারণ, কিছু কিছু ফসল ঘরে তোলার সময় এটি। আবার, এই সময়ের বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রাচীন চীনা প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘শরতের শুরুতে বৃষ্টি হলে ফসলের বাম্পার ফলন নিশ্চিত।’

ডাম্পলিং চীনাদের প্রিয় খাবার। তবে, শানতুং প্রদেশের বাসিন্দারা শরতের শুরুতে বিশেষভাবে এই ডাম্পলিং রান্না করে খায়। একে তারা বলে ‘শরৎখাওয়া’। ‘শরতের শুরু’ সৌরপদের প্রথম দিনে পরিবারের বড় কর্তা ঘরের মাঝখানে দাঁড়ান এবং পেয়ালাভর্তি ডাম্পলিংয়ের পূজা করেন।

আরও পড়ুন : চীনে স্বেচ্ছায় অঙ্গ দান ব্যবস্থা ও দশ বছরের লিন ওয়েনচুনের কথা

পূজার সময় তিনি শরতে ভালো ফলনের জন্য প্রার্থনা করেন। শানতুংয়ের অধিকাংশ পরিবারেই ত্রয়োদশ সৌরপদের শুরুতে বিশেষভাবে ডাম্পলিং খাওয়ার রেওয়াজ আছে এখনো।

এদিকে, চ্যচিয়াং প্রদেশের ই উ (Yiwu) এলাকার মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই ত্রয়োদশ সৌরপদে বিশেষভাবে রেড বিন খেয়ে আসছেন এই প্রথা চলে আসছে থাং রাজবংশ (৬১৮-৯০৭) ও সুং রাজবংশ (৯৬০-১২৭৯) আমল থেকে।

লোকেরা লিছুয়ু সৌরপদের প্রথম দিন ৭ থেকে ১৪টি রেড বিন হাতে নেয় ও কুয়ার পানি দিয়ে সেগুলো গিলে ফেলে। গেলার সময় অবশ্যই পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। তারা বিশ্বাস করেন যে, শরতের শুরুতে এভাবে রেড বিন খেলে আমাশয় থেকে বাঁচা যায়।

গরমে লাউ উপকারী; পেট ঠাণ্ডা রাখে। ছিং রাজবংশ আমলে (১৬৪৪-১৯১১) চীনারা লিছুয়ু সৌরপদে বিশেষভাবে লাউ খেতেন। তারা গাছ থেকে লাউ সংগ্রহ করে ঘরের বাইরে পুরো একদিন রেখে দিতেন। পরে লিছুয়ু সৌরপদের প্রথম দিন সেই লাউ রান্না করে খেতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, এভাবে লাউ খেলে শরতের গরম থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন : নিজের মহাকাশকেন্দ্র: বড় ধাপ এগুলো চীন 

চীনের সর্বত্র এখন আর এই প্রথার প্রচলন নেই। তবে, বেইজিংয়ের কাছাকাছি কেন্দ্রশাসিত শহর থিয়েনচিনের বাসিন্দারা এখনো এই প্রথা ধরে রেখেছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, এই সৌরপদে বিভিন্ন ধরনের লাউ শরতে তো বটেই, এমনকি পরবর্তী শীত ও বসন্তেও ডায়রিয়া থেকে বাঁচাতে পারে। 

চিয়াংসু প্রদেশের ইয়ানছ্যংয়ের উত্তরাঞ্চলে একটি ইন্টারেস্টিং প্রথা প্রচলিত আছে। এই প্রথার নাম ‘শরতের স্পর্শ’। প্রথা অনুসারে, লিছুয়ু সৌরপদের আগের দিন ফলমূলের সকল ব্যক্তিগত বা সরকারি বাগান ও ক্ষেত-খামার বাহ্যত উন্মুক্ত থাকে।

যে কেউ, যেকোনো বাগানে প্রবেশ করে ইচ্ছেমতো ফলমূল ছুঁয়ে দেখতে ও বিনামূল্যে সেগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। এতে বাগানের মালিক রাগ করেন না। ‘শরতের স্পর্শে’ যদি তাদের বাগান উজাড়ও হয়ে যায়, তবুও তারা হাসিমুখে তা মেনে নেন। কারণ, এটাই প্রথা।

কোনো কোনো মালিক আবার কিছু ফলমূল বাগানে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করেন, যাতে রাতে যারা আসবেন, তারা সেগুলো নিতে পারেন; তাদেরকে যেন খালি হাতে ফিরে যেতে না হয়।

আরও পড়ুন : ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়ছে চীনাদের

হাংচৌ-এর বাসিন্দারা শরতের শুরুতে পিচফল খেয়ে থাকেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। পিচফল চীনের বলতে গেলে সবাই কমবেশি পছন্দ করে। আমি যখন প্রথম চীনে আসি, তখন আমাদের চীনা লিউ আপা যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে, বেশি বেশি পিচফল খেতে হবে।

সেই থেকে সুযোগ পেলে এই ফল খাই। কিন্তু লিছুয়ু সৌরপদে হাংচৌ-য়ের বাসিন্দারা শুধু পিচ খান না, এর বীজও যত্ন করে সংরক্ষণ করেন। এই সংরক্ষিত বীজগুলো নতুন বছরের আগের দিন তারা লাকড়ির চুলায় জ্বালিয়ে ভস্ম করেন। তারা বিশ্বাস করেন, এমন করলে গোটা বছরের জন্য যেকোনো ধরনের মহামারি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

আমরা জানি, কোভিড মহামারি সবার আগে চীনে বড় স্কেলে আক্রমণ চালিয়েছিল। চীন সেই আক্রমণ মোকাবিলায় সফল হয়েছে বিপুলভাবে। হাংচৌবাসীর এই প্রাচীন প্রথা কি এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা সত্যিই রেখেছিল? অন্তত তাদের নিজেদের জীবনে? বলা মুশকিল।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)