ছবি : সংগৃহীত

কিশোর বয়সে ঢাকাসহ সারা দেশের যেখানেই বেড়াতে যেতাম মাইকে একটি গানই খুব বেশি বাজতে শুনতাম—

'তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে
(আমার) মরণ যাত্রা যেদিন যাবে
তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থেকো
শেষ দেখাটা দেখতে পাবে।'

মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কারণ আমি তখন সদ্য একটি মেয়ের প্রেমে ধোঁকা খেয়ে দিশেহারা। তাই শিল্পীর নামটা না জানলেও সে যে ভারতীয় শিল্পী সেটা আমি জানতাম। কথাগুলো খুব ভাবতাম।

হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার সাথে নিজেকে কল্পনা করার একটি পরিসর তৈরি করতাম। তারও অনেক পরে জেনেছিলাম গানটির শিল্পী কিশোর কুমার।

আরও পড়ুন : বলিউড ট্র্যাজেডি কিং দিলীপ কুমার: সর্বকালের সেরা অভিনেতা

আমার মতোই সেও একজন বাঙালি। গানটি আমাকে হারিরে যাওয়া প্রেমের কাছে নিয়ে যাচ্ছে বারবার। এটাই আমার মনের শান্তি।  এটাই কোনো শিল্পীর, শিল্পের সার্থকতা। 

তারপর সময়ের সাথে সাথে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পীদের অন্যতম কিশোর কুমার। বাংলা বা হিন্দি তার প্রায় সকল গানই অনেকবার করে শোনা। আমার বাবাও মো. রাফির পরেই তার খুব ভক্ত। আজকে সেই মহান শিল্পীর জন্মদিন।

আরও পড়ুন : উত্তম কুমার কেন মহানায়ক?

এককথায়  কিশোর কুমার ছিলেন হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম সফল প্লেব্যাক গায়ক। আমার নজরে কিশোর কুমার সারা পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তি। পাশাপাশি তিনি অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার।

হিন্দি ছবিতে গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি বাংলা, মারাঠি, আসাম, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালায়লাম, উড়িষ্যা এবং উর্দুসহ অনেক ভাষায় গান গেয়েছেন। সেরা গানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।

বাংলায় নয় কিশোর কুমার খান্ডোয়া নামের (মধ্যপ্রদেশ) একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৪ আগস্ট ১৯২৯ সালে। তিনি একটি বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার জন্মের নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী।

কেলাল গঙ্গোপাধ্যায় নামের এক আইনজীবীর ঘরের সন্তান ছিলেন কিশোর কুমার কিন্তু মা গৌরী দেবী সর্বদা থাকতেন ধর্ম কর্ম নিয়ে।  দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে অশোক কুমার, অনুপ কুমার ফিল্মে কাজ করতেন এবং বোন সতী দেবী সাধারণ গৃহিণীই ছিলেন বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন : প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার : চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেত্রী 

আমরা জানি, সবচেয়ে বেশি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতার রেকর্ড কিশোর কুমারের। তিনি সেরা প্লেব্যাক গায়কের জন্য ৮টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কারেও ভূষিত হন। সেই বছর থেকে, মধ্যপ্রদেশ সরকার হিন্দি সিনেমায় অবদানের জন্য ‘কিশোর কুমার পুরস্কার’ (একটি নতুন পুরস্কার) প্রবর্তন করে। যেটি বাঙালি হিসেবে অবশ্যই গর্ব করার মতো।

কিশোর কুমার ১১০ জন ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গীত পরিচালকের সাথে হিন্দিতে প্রায় ২৬৭৮টি গান গেয়েছেন। শুধুমাত্র তিনি নিজে সঙ্গীত রচয়িতা হয়েও আর ডি বর্মনের সাথে ৫৬৩টি গান গেয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যেহেতু সে সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য গান করেছেন।  কোন দ্রুপদী গায়ক বা পণ্ডিত নন সেজন্য ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত করেননি।

কিন্তু কিশোর কুমারের এই সফলতা অন্য অনেকের মতোই অত সহজ ছিল না। বড় ভাই অশোক কুমারের ফিল্ম ক্যারিয়ার কিছুটা মজবুত হলে তার পরিবার মুম্বাইতে চলে যায়। এই সময় তিনি তার নাম আভাস কুমার থেকে পরিবর্তন করে কিশোর কুমার রাখেন। কিশোর কুমার তার গানের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘বোম্বে টকিজ’ ছবির মাধ্যমে। এই ছবিতে প্লেব্যাক গায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন : লতা মঙ্গেশকর : সুর সম্রাজ্ঞী

১৯৪৬  সালের চলচ্চিত্র ‘শিকারি’ ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র যেখানে তিনি একজন অভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এরপরে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৪৮ সালে তিনি ‘জিদ্দি’ ছবিতে দেব আনন্দের জন্য একটি গান গেয়েছিলেন।

ছবিতে কিশোর কুমারের কাজ অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল এবং এর জন্যই আরও অনেক কাজ পেতে থাকেন এবং মহান কিশোর কুমার হওয়ার পথে এগিয়ে যান।

১৯৫৪ সালে তিনি বিমল রায়ের নৌকরি ছবিতে একজন বেকার যুবকের সংবেদনশীল চরিত্রে অভিনয় করে তার অসাধারণ অভিনয় প্রতিভারও পরিচয় দেন। এরপরে ১৯৫৫ সালে ‘বাপ রে বাপ’, ১৯৫৬ সালে ‘নতুন দিল্লী’, ‘মি. আমার’ এবং ‘আশা’, এবং ১৯৫৮  সালে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ যেখানে কিশোর কুমার ও তার দুই ভাই অশোক কুমার এবং অনুপ কুমারের সাথে মিলে কাজ করেছিলেন। সিনেমাটি সেই সময়ে অনেকেই ব্যবসা সফল হয়েছিল।

আরও পড়ুন : শাঁওলী মিত্র : কিংবদন্তি অভিনেত্রী 

১৯৮৭ সালে কিশোর কুমার সিদ্ধান্ত নেন যে চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেওয়ার পরে, তিনি তার গ্রাম বা ছোট শহর খান্ডোয়ায় ফিরে যাবেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দুধ জিলেবি খাওয়ার জন্য খান্ডোয়ায় বসতি স্থাপন করবে।’ কিন্তু তার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়।

১৯৮৭  সালের ১৩ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে খান্ডোয়াতেই সমাহিত করা হয়। কিশোর কুমারের মৃত্যু ভারতীয় সিনেমা জগতে একটি বড় ক্ষতি তো ছিলই আমার মতো কোটি দর্শককেও তিনি অসহায় করেছেন। কিশোর কুমারের জীবনে এমন অনেক বাঁক এবং ঘটনা ঘটেছে, যা আমার এই এক লেখায় তুলে ধরা অসম্ভব। তবুও আমার এই প্রচেষ্টা সুরের সম্রাট কিশোরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আমি গায়ক নই বা গানের কোনো বিশারদও নই কিন্তু তার গানের জাদু আমার মনে প্রাণে লেগে আছে। আমার প্রথম প্রেমের সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত আজও আমাকে নাড়া দিয়ে বলে আবার যদি সেই সময়ে ফিরে যেতে পারতাম। আজও তার গান শুনলে মনে হয় তিনি সব প্রজন্মের গায়ক।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক