ছবি : সংগৃহীত

যে ৫ জন মারা গেছেন, তাদের জন্য আমাদের সবার আহাজারি, সবার শোক। কিন্তু আমার সকল ভাবনা হৃদয় আর রিয়ামনিকে নিয়ে। যারা মারা গেছেন, তারা তো মরে বেঁচেছেন। কিন্তু হৃদয়-রিয়ামনির বেঁচে থাকাটা কী কঠিন করে দিয়ে গেলেন তারা।

হৃদয় আর রিয়ামনির জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন এভাবে বিষাদের কালো চাদরে ঢেকে যাবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সিনেমায় যখন এমন বেদনার গল্প দেখি, ভাবি এসব কল্পনায় সম্ভব। বাস্তবে এমন কখনো হয় না। কিন্তু এখন দেখছি বাস্তব কল্পনার চেয়েও নিষ্ঠুর, অন্তত এই বাংলাদেশে।

হৃদয় আর রিয়ামনির বিয়ে হয়েছে ১৩ আগস্ট ২০২২। ১৫ আগস্ট ছিল বৌভাত। অনুষ্ঠান শেষে ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসায়ী রুবেল নিজে গাড়ি চালিয়ে তার একমাত্র ছেলে হৃদয়কে শ্বশুর বাড়িতে দিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন। গাড়িতে আরও ছিলেন রিয়ামনির মা, খালা এবং খালার দুই সন্তান।

আরও পড়ুন : শহর যেন মৃত্যুফাঁদ 

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে বেয়াই-বেয়াইন নিশ্চয়ই মজা করছিলেন, নিশ্চয়ই হৃদয় আর রিয়ামনি বিভোর ছিল নতুন জীবনের স্বপ্নে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া বলি না আমরা, সেটার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে উত্তরার এই ঘটনা। গাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ তাদের মাথায় সত্যি সত্যি আকাশ ভেঙে পড়ে।

বৌভাতের দিনেই এতিম হয়ে গেলেন হৃদয় আর রিয়ামনি। একটি দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু। হৃদয় আর রিয়ামনি বাকি জীবন কীভাবে সইবে এই বেদনার ভার?

আমি জানি, এই হত্যাকাণ্ডে লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হবে, কেউ কেউ বরখাস্ত হবেন; কিন্তু খুনের বিচার হবে না...

বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে, দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি বলি এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যা; অবহেলাজনিত হত্যা, খামখেয়ালের কারণে হত্যা। যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করতে হবে, সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। লিখলাম বটে 'করতে হবে', কিন্তু আমি জানি এটা হবে না।

আরও পড়ুন : দুর্ঘটনা নাকি খুন? 

বাংলাদেশে কখনোই উচিত কাজ ঠিক সময়ে হয় না। আর হয় না বলেই এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বারবার ঘটে। গার্ডার ধসে দুর্ঘটনা তো বাংলাদেশে প্রথম নয়। প্রথম ঘটনাকে আমি দুর্ঘটনা হিসেবে মানব। কিন্তু প্রথম ঘটনার পর তো আমাদের সবার সাবধান হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা হই না।

আমরা খরচ বাঁচাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিই না, কারণ মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই আমাদের কাছে। আমরা কোনোকিছু কেয়ার করি না, কারণ মানুষের জীবন আমাদের কাছে তুচ্ছ।

আমি জানি, এই হত্যাকাণ্ডে লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হবে, কেউ কেউ বরখাস্ত হবেন; কিন্তু খুনের বিচার হবে না। উন্নয়ন কাজ তো শুধু বাংলাদেশে হয় না। বিশ্বের সব দেশেই উন্নয়ন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এমন খোলা রাস্তায় মৃত্যুর ফাঁদ পাতা থাকে না কোথাও।

আরও পড়ুন : কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? 

উত্তরার যে রাস্তায় গার্ডার পড়ে চলতি গাড়িতে ৫ জন মানুষ মুহূর্তেই মারা গেলেন, সেটা কিন্তু ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক। ফেসবুকে দেখলাম আমার পরিচিত, বন্ধুবান্ধব অনেকেই প্রতিদিন এই রাস্তায় চলাচল করেন। কিছুদিন আগে আমিও এই রাস্তায় গিয়েছি। তাই এই মৃত্যু আসলে র‍্যানডম।

যে কেউ এই গার্ডারের নিচে চাপা পড়তে পারতেন। যে কেউ মানে যে কেউ; আমি, আপনি, যে কেউ। যে ৫ জন মারা গেছেন, তাদের কিন্তু কোনো দোষ নেই, তারা কোনো আইন ভাঙেননি, ভুল রাস্তায়ও যাননি, তারা ঠিক রাস্তায়ই ছিলেন। দেশটাই আসলে ভুল রাস্তায় চলে গেছে।

তাদের একটাই অপরাধ, তারা এমন একটা দেশে বাস করেন, যে দেশে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, আইনকানুনের কোনো বালাই নেই। উন্নয়ন কাজ আপনি করেন, আপত্তি নেই। কিন্তু সবার আগে তো মানুষের নিরাপত্তা।

আরও পড়ুন : সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : যে জলে আগুন জ্বলে 

বাংলাদেশে নিরাপত্তার ধারণাই নেই। নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মানুষ মারা যায়, দেয়াল ধসে মারা যায়, স্কুলের গেট ভেঙে শিশু মারা যায়। মৃত্যু যেন এখানে ডালভাত, বেঁচে থাকাই যেন প্রতিদিনের আপস, নিত্যদিনের লড়াই।

চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যুর কথা না হয় ভুলে যান, এই বিআরটি প্রকল্পেই এটি চতুর্থ দুর্ঘটনা। এর আগে জুলাইয়ে একজন মারা গেছেন, আগের দুটি দুর্ঘটনায় ৬ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু বারবার দুর্ঘটনায়ও তাদের টনক নড়েনি।

পুরান ঢাকায় ঘরে ঘরে রাসায়নিকের গুদাম। এখানে নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই। নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ট্র্যাজেডির পরও আমাদের চোখ খোলেনি।

নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা এই বিআরটি প্রকল্প আমাদের অদক্ষতার দলিল হয়ে মানুষকে ভোগাচ্ছে এবং হত্যা করছে ১০ বছর ধরে।

আরও পড়ুন : নিমতলী, চুড়িহাট্টা, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : এর শেষ কোথায়? 

২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা। এরমধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ৫ বছরের জায়গায় ১০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু প্রকল্প শেষের নামগন্ধ নেই।

বলছিলাম বাংলাদেশে বেঁচে থাকাটাই কঠিন, মরে যাওয়াটাই সহজ। একটা শোকের ধাক্কা কাটাতে আমরা সময় পাই ৫ ঘণ্টা। জাতীয় শোক দিবসে গোটা দেশেই শোকের আবহ। বিকেলে উত্তরার গার্ডার দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু সেই শোককে আরও দুর্বিসহ করে তোলে। এর মাত্র ৫ ঘণ্টা আগে যে চকবাজারে চারতলা ভবনে আগুন লেগে ৬ জন হোটেল শ্রমিক অঙ্গার হয়ে গেলেন, সেই শোকও চাপা পড়ে যায় গার্ডারে।

আরও পড়ুন : রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : এখনো শ্রমিক কেঁদে মরে

পুরান ঢাকায় ঘরে ঘরে রাসায়নিকের গুদাম। এখানে নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই। নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ট্র্যাজেডির পরও আমাদের চোখ খোলেনি। বারবার পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামে আগুনে মানুষের মৃত্যুকে আপনি কতদিন দুর্ঘটনা বলবেন। এ তো স্রেফ হত্যাকাণ্ড।

প্রিয় শহরের পাড়ায়-পাড়ায়, মোড়ে-মোড়ে, রাস্তায় রাস্তায় মৃত্যুফাঁদ পাতা এবং এই মৃত্যু উপত্যকাই আমাদের দেশ। আমি জানি এরপরও পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম থাকবে, এরপরও উন্নয়ন কাজ হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই।

এই লেখা নিজের মনের রাগের প্রকাশ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। কেউ শুনবে না, কোনো ব্যবস্থা হবে না, কারো শাস্তি হবে না। আমরা শুধু মুখ বুজে সয়ে যাব এবং হুট করে একদিন টুপ করে মরে যাব।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com