লুৎফুল হায়দার সোহাগ, একসময় দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দৈনিক আজকের কাগজ বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ধারা। আধুনিক, স্মার্ট ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেই টিমে ফরহাদ টিটোর নেতৃত্বে ছিলেন উৎপল শুভ্র, সাইফুর রহমান খোকন আর লুৎফুল হায়দার সোহাগ। তবে সোহাগ ভাই অনেক আগেই সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যাংকার বনে গেছেন। সাংবাদিকতার মতো ব্যাংকার হিসেবেও তিনি সফল। বর্তমানে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার বর্তমান কর্মস্থল মিডিয়া পাড়ায়, মানে কারওয়ানবাজারে। তাই কাজে-অকাজে তার সাথে দেখা হয়, কারণে-অকারণে কথা হয়।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ফোনে তার ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনে আমিও কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। ছোট ভাইকে নিয়ে তিনি সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন পারিবারিক কাজে। গ্রামের দিকে ছিলেন বলে কোনো আপডেটও জানতেন না। সুনামগঞ্জ থেকে ভেতর দিয়ে কোনাকুনি শর্টকাটে হবিগঞ্জের কাছের একটা জায়গায় এসে ঢাকা-সিলেট হাইওয়েতে উঠলেন। ইচ্ছা, বাসে ঢাকায় চলে আসবেন। হাইওয়েতে এসে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। পরিবহন মালিকরা যে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন, সে ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতেন না তিনি।

জানবেন কীভাবে, মালিকরা তো কোনো ঘোষণা দেয়নি। এখন তিনি হাইওয়েতে এসে যেন অকূল পাথারে পড়লেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে ততক্ষণে রাত নামছে। পেছনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, সামনে যাওয়ারও সুযোগ নেই। সেখানে থাকার মতো কোনো হোটেলও নেই। কী করবেন তিনি?

অনেকে বলছেন, ‘ধর্মঘট’, কেউ বলছেন, ‘অঘোষিত ধর্মঘট’। আসলে কিন্তু কোনোটাই নয়। এটা স্রেফ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের দাবি আদায়ের ঘৃণ্য ও বেআইনি কৌশল।

একজন সিনিয়র ব্যাংকারের কণ্ঠে এমন অসহায় আতঙ্ক শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার কাছে তিনি গাড়ি কখন চলবে, তার আপডেট জানতে চাইছিলেন। সে আপডেট আমি কেন, স্বয়ং সড়ক পরিবহন মন্ত্রীও জানেন না। পরে তিনি চড়া দামে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে মধ্যরাতে ঢাকা ফিরতে পেরেছিলেন। তবে শুক্রবার ও শনিবার পত্রিকায়, টিভিতে, অনলাইনে, অফলাইনে যত মানুষের দুর্ভোগের কথা পড়ছি, শুনছি, দেখছি; সে তুলনায় সোহাগ ভাইয়ের দুর্ভোগ অতি সামান্য। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ। পকেটে টাকাও আছে। চাইলে মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানায় হলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারতেন। কিন্তু দেশজুড়ে পথে পথে কত মানুষের দুর্ভোগ, কত হাহাকার, অসুস্থ মানুষের কান্না, অসহায় মানুষের চিৎকার; নারী, শিশু, বৃদ্ধ মানুষের অসহায়ত্বের কান্না কোনোদিন পৌঁছাবে না পরিবহন মালিক বা আমাদের নীতিনির্ধারকদের কানে।

অসহায়ত্বের ধরনগুলো একেকটা একেকরকম। কক্সবাজার বা কুয়াকাটা বা কোনো পর্যটন এলাকায় গিয়ে সপরিবারে আটকা পড়েছেন অনেকে। সময় শেষ, বাজেট শেষ, হোটেল ছেড়ে দিয়েছেন; এখন কোথায় যাবেন? অনেক বছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন, সাথে অনেক লাগেজ। মায়ের কাছে যাবেন বলে প্রাণ কাঁদে।

ছোট্ট শিশুর চিকিৎসার জন্য ঢাকা এসেছিলেন মা। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে। শিশুকে নিয়ে মা গেলেন গাবতলী। এখন সেখানেই বসে আছেন। হাসপাতালে ফেরার উপায় নেই, ঢাকায় থাকার মতো কোনো স্বজন নেই, হোটেলে থাকার মতো পয়সা নেই; এখন অসুস্থ এই শিশু নিয়ে এই অসহায় মা কী করবেন?

শুক্রবার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা। এছাড়া ১৯টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাও ছিল সেদিন। কত প্রস্তুতি, কত স্বপ্ন পরিবহন মালিকদের খামখেয়ালিতে ধুলায় মিশে গেল।

অনেকে দৌড়ে, হেঁটে, রিকশায়, সিএনজিতে ১৫/২০ মিনিট পর পরীক্ষার হলে পৌঁছলেও ঢুকতে পারেননি। পরীক্ষার হলের সামনের বাতাস ভারী হয়েছে শিক্ষার্থী আর চাকরি প্রার্থীদের কান্নায়। রাজপথে কত মানুষের গল্প, কান্না, অভিশাপ কোনোদিনই হয়তো ছুঁতে পারবে না আমাদের পাষাণ হৃদয়।

অনেকে বলছেন, ‘ধর্মঘট’, কেউ বলছেন, ‘অঘোষিত ধর্মঘট’। আসলে কিন্তু কোনোটাই নয়। এটা স্রেফ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের দাবি আদায়ের ঘৃণ্য ও বেআইনি কৌশল। যত দুর্ভোগ, তাদের বার্গেইন পাওয়ার তত বাড়বে। আমরা মানি আর না মানি সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে।

ধর্মঘট ডাকারও নিয়ম আছে। দাবি মানার জন্য অন্তত ১৫ দিন সময় দিয়ে ধর্মঘট ডাকতে হয়। আর ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে ধর্মঘট ডাকলে মানুষের দুর্ভোগ তেমন হয় না। সবাই যার যার মতো গুছিয়ে বসতে পারেন। হুট করে বিনা নোটিশে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেললেই যেন কেল্লা ফতে। দুর্ভোগ যত বেশি ক্ষমতাও তত বেশি, দাবি আদায়ের সুযোগও তত বেশি। 

পরিবহন মালিকরা বলছেন, ডিজেলের বাড়তি দামে গাড়ি চালালে তাদের পোষাবে না, তাই তারা গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন। তাদের যুক্তি মানলাম। তাহলে সিএনজিচালিত গাড়ি বন্ধ কেন? আসলে খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। তাদের মূল লক্ষ্য মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়। ২/৪ দিন লসে গাড়ি চালালে তাদের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাসভাড়া বাড়বে, এটা জানা কথাই। এরমধ্যে রোববার বৈঠকও ডাকা হয়েছে। মাঝের দুইটা দিনও তাদের সইলো না। বাসভাড়া যে বাড়বেই এটা মালিকরাও জানেন, তারপরও সারাদেশকে অচল করে দেওয়া কেন? এটা আসলেই বার্গেইন পাওয়ার বাড়ানোর কৌশল। ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ ভাগ, ভাড়াও বাড়বে ২৩ ভাগ। কিন্তু মালিকরা চান ৫০ ভাগ বাড়াতে। এইটুকুর জন্যই এতকিছু।

ধর্মঘট ডাকারও নিয়ম আছে। দাবি মানার জন্য অন্তত ১৫ দিন সময় দিয়ে ধর্মঘট ডাকতে হয়। আর ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে ধর্মঘট ডাকলে মানুষের দুর্ভোগ তেমন হয় না।

আসলে সরকার বা পরিবহন মালিক কারো কাছেই সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য নেই। ওবায়দুল কাদের একটা নামকাওয়াস্তে আহ্বান জানিয়েছেন বটে, কিন্তু সে আহবান কানে তোলেনি মালিকরা। একবার ভাবুন তো, পরিবহন মালিকরা যা করছে, তা যদি বিএনপি বা জামাত করতো; তাহলে কী দাঁড়াত বিষয়টা? এতক্ষণে ১০ হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা, দেশজুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়ে যেত।

শাপলা চত্বর থেকে লাখ পাঁচেক মানুষকে সরাতে যে সরকারের ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল, তাদের সময়ে কীভাবে মানুষকে অনির্দিষ্টকাল দুর্ভোগের হুমকি দেওয়া সম্ভব? যে সরকার বিএনপি-জামাত বা ভিন্নমতের মানুষের কাছে ফ্যাসিস্ট, সেই সরকার পরিবহন মাফিয়াদের কাছে এমন নতজানু কেন? তাহলে কি যারা মানুষকে বেশি ভোগান্তি দিতে পারবে, তাদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি?

আমি একটু ভিন্নভাবে ভাবতে চাই। এখন যারা পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা সবাই সরকারের সমর্থক। আর তাদের পালের গোদাকে সবাই চেনেন, সরকারের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। এই যে ধর্মঘট ডাকার নিয়মে না গিয়ে হুট করে গাড়ি চালানো বন্ধ করে মানুষকে জিম্মি করে ফেলা যায়; এটা শাজাহান খানের প্যাটেন্ট করার মতো আবিষ্কার। দাবি আদায়ের সহজতম কৌশল আবিষ্কার করায় মালিক-শ্রমিকরা গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী বা সাত রাস্তার ট্রাক স্ট্যান্ডে তার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে পূজা করতে পারে। কিন্তু ভূক্তভোগী সাধারণ মানুষ আজীবন তাতে থুথুই দেবে।

পরিবহন মালিকরা বলছেন, ডিজেলের বাড়তি দামে গাড়ি চালালে তাদের পোষাবে না, তাই তারা গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন। তাদের যুক্তি মানলাম। তাহলে সিএনজিচালিত গাড়ি বন্ধ কেন?

আমার ধারণা, যান চলাচল বন্ধ রাখার বিষয়ে সরকারে প্রচ্ছন্ন সায় আছে। নইলে বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার দিনই বাসভাড়া সমন্বয়ের বৈঠকটি হতে পারত। তবে সবচেয়ে ভালো হতো, আগে বাসভাড়া বাড়িয়ে পরে তেলের দাম বাড়ানো এবং দুটি একই সঙ্গে কার্যকর করা। এখন পরিবহন মালিকরা চাইছে দুর্ভোগ বেশি হোক, তাতে দাবি বেশি আদায় হবে। সরকারও যেন বসে আছে কখন অতিষ্ঠ জনগণ ফেসবুকে দাবি তোলে, আমরা আর পারছি না, ভাড়া বাড়িয়ে দাও। দুই পক্ষই মানুষের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। তাদের কাছ থেকেই দাবিটা ওঠাতে চাইছে।

পরিবহন মালিকদের সাথে সরকারের ফারাকও নেই। পরিবহন মালিকরা বিনা নোটিশে গাড়ি বন্ধ করেছে। সরকারও বিনা নোটিশে, কোনো গণশুনানি ছাড়া তেলের দাম বাড়িয়েছে। সব আসলে একই গোয়ালের। তবে এবার পরিবহন শ্রমিকরাও মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। গাড়ি না চললে তারা টাকা পাবে না। কিন্তু পরিবহন মালিকরা যে সরকার, জনগণ, শ্রমিক তথা গোটা দেশকে বেআইনিভাবে জিম্মি করে রেখেছে; তার কোনো বিচার হবে না?

আমার একটা বিনীত প্রস্তাব, রোববারের বৈঠকে তেলের বাড়তি দামের সাথে সমন্বয় রেখে পরিবহন ভাড়া ২৩ ভাগ বাড়ানো হোক। এরপর যারা সুযোগ পেলেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চায়; সেই পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সব ক্ষমতা বিএনপি-জামাত আর ভিন্নমতের বিরুদ্ধে প্রয়োগ না করে কিছু ক্ষমতা জনগণের স্বার্থে এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হোক।

লকডাউনে দিনের পর দিন যানবাহন ছাড়া আমরা চলেছি। আরও কিছুদিন চলব। কিন্তু বারবার এই পরিবহন মাফিয়াদের জিততে দেব না। সরকার এবার অন্তত এই ভয়ঙ্কর চক্রটি ভেঙে ফেলুক। জিম্মি করার শক্তি দিয়ে কেউ যেন নিজেদের সরকারের চেয়ে বড় ভাবতে না পারে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ