ছবি : সংগৃহীত

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা ভয়ংকর দিন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ওই আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ভয়ানক বিস্তার ঘটে দেশে। ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা দেখেছি সেই সময়। দেখেছি প্রশাসনের সহযোগিতায় বাংলা ভাইয়ের উত্থান।

জেএমবিসহ নানা জঙ্গিগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতা। এমনই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেদিন সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে জড়ো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু তারাই সেদিন ভয়ংকর এক সন্ত্রাসের শিকার হন, যার মূল লক্ষ্য ছিলেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন : একুশে আগস্ট : রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন 

ঘৃণ্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল ওই সমাবেশে। রাস্তার ওপর খোলা ট্রাকের অস্থায়ী মঞ্চে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই দফায়-দফায় গ্রেনেড বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে উঠে।

চারদিকে ছোপছোপ রক্ত, ছিন্নভিন্ন শরীর, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের ছোটাছুটিতে সেদিন ওই এলাকা হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান রক্তাক্ত শূন্য দৃষ্টিতে পড়ে ছিলেন সড়কে। ওই গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন। আহত হন চারশ’র বেশি নেতাকর্মী। তাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন : একুশে আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট

যখন গ্রেনেড হামলা করা হয় তখন মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা শেখ হাসিনার চারপাশে ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেন যাতে তার গায়ে কোনো আঘাত না লাগে। নেতাকর্মীরা জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জীবন রক্ষা করেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার দুই কান ও চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপূরণীয় ক্ষতি হয় দেশের গণতন্ত্রের।

জোট সরকারের ষড়যন্ত্র

দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার এই হামলার আগে-পরে প্রত্যেক ঘটনায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ষড়যন্ত্র। ঘটনাস্থলে গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গেলেও শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টায়ই করেছিল হামলাকারীরা। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের যোগসাজশে এটি ছিল একেবারে ঠাণ্ডামাথায় হত্যার পরিকল্পনা।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তার গাড়ি লক্ষ্য করে তখনো গ্রেনেড ও গুলি ছোড়া হচ্ছিল। কিন্তু তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে। শুধু তাই নয়, নেতাকর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করতে যায় ঠিক সেই সময় পুলিশ উল্টো লাঠিপেটা ও তাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। কাঁদানে গ্যাস ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে আলামত নষ্ট করে।

সেই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তে দেশ-বিদেশের নানা চাপেও তৎকালীন সরকার একের পর এক বাধা তৈরি করতে থাকে। পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় প্রশ্ন ওঠে। প্রকৃত সত্য লুকিয়ে রাষ্ট্রীয় মদদে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হওয়া প্রথম তদন্তের কোনো প্রতিবেদনই দাখিল হয়নি।

শুরু থেকেই এই ঘটনার হোতাদের আড়াল করতে তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে নিরপেক্ষ তদন্তে সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দের দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।

আরও পড়ুন : অসাম্প্রদায়িক মানবিক বঙ্গবন্ধু

শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতেই যে এই হামলা হয়েছিল এবং তাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। জঙ্গিদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাশের পরিকল্পনা থেকে হামলা চালানো হয়েছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে।

গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা হয়েছিল বলেও তদন্তে এসেছে। হামলায় অংশ নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। আর এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধন।

হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, সেই সময় সরকার কেবল অপরাধীদের বাঁচাতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়নি, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকেই এই তৎপরতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সেই সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর অপরাধীদের না ধরে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

হামলার পেছনে তারেক রহমান

২১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাসহ জঙ্গি গোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে দায়ী করা হয় মুফতি হান্নানকে। নাশকতা চালিয়ে হত্যার এক মামলায় ২০১৭ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে জবানবন্দিতে এই হামলার পেছনে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন : তরণী চলছে শুভ লক্ষ্যে 

২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে এই হামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। পাশাপাশি সেই ঘটনার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের নানাদিকও জানা যায়।

জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে শত্রু ভাবে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাশ করতে চেয়েছিল তারেক। জবানবন্দিতে ঘটনার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের পাশাপাশি হামলা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িতদের নাম জানান তিনি। তাতেই আসামি হন তারেক রহমান।

২০০৭ সালে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে ‘প্রকৃত তথ্য’ বেরিয়ে আসতে থাকে। উদঘাটিত হয় জজ মিয়া নাটক। গ্রেনেড হামলার আগে ঢাকায় ১০টি বৈঠক হয় এবং এসব বৈঠকে তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

জোট সরকারের আমলে বনানীর হাওয়া ভবন থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তখন বেগম জিয়ার সরকার ক্ষমতায়, হাওয়া ভবন বিকল্প পাওয়ার সেন্টার ছিল। মুফতি হান্নান নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে যে, অপারেশন চালানোর পূর্ব মুহূর্তে তারেক রহমানের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।

জজ মিয়া নাটক

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যখন গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে, তখন একজন লোককে খুঁজে বের করার জন্য বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা দায়িত্ব নেন। বিএনপি সরকারের আমলে এই হামলায় নোয়াখালীর নিরীহ যুবক মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।

আরও পড়ুন : মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা 

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তিনি জড়িত ছিলেন সেই স্বীকারোক্তি আদায় করিয়ে নেন। সিআইডির মাধ্যমে তার পরিবারকেও ‘মাসিক খরচের টাকা’ দেওয়া হতো। জেলখানায় থাকার সময় তার মাকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে দিত। ২০০৬ সালে এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। তদন্তে ‘আসল রহস্য’ উদ্ঘাটনের পর কারামুক্ত হন জজ মিয়া।

মামলার রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণ

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ইতিহাসের ভয়াবহ এই হামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ক্ষমতাসীন দল বিএনপির একজন নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ জনের।

আরও পড়ুন : আমি তোমাদেরই লোক 

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রের সহায়তায় ওই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। আদালত বলেন, ঘাতকচক্রের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রুখে দেওয়া এবং দেশে স্বৈরশাসন ও জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা।

রাষ্ট্রের সহায়তায় ওই হামলায় যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে বিচারক বলেন, প্রশ্ন ওঠে, কেন এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার? রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের উপর পৈশাচিক আক্রমণ?

তাই এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিএনপির নেতারা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় তারা এড়াতে পারেন না।

আরও পড়ুন : ফিরে এলেন দুঃসাহসী নাবিক 

বিএনপির যেসব নেতার নাম এসেছে, আদালতের বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন, বিএনপি নেতৃত্বের উচিত হবে তাদের দল থেকে বাদ দেওয়া। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানেরও উচিত হবে দলের মূল কাণ্ডারির পদ থেকে এখনই সরে দাঁড়ানো। এটা রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন।

রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো রাজনৈতিক নেতার দলীয় চেয়ারম্যানের পদে আসীন থাকা মোটেই সমীচীন নয়। তা না হলে ২১ আগস্টের মতো ভয়ংকর ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এই ভূমিকাকে দেশের মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে?

এই ঘটনা বিএনপির বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। এই কলঙ্ক মুছে ফেলা বিএনপির জন্য এক কথায় অসম্ভব।

ফরিদুন্নাহার লাইলী ।। কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ