ছবি : সংগৃহীত

কথায় আছে বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হলে তা আর ফেরত আসে না। বেফাঁস মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে কেউ কেউ গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপান। বলেন, মিডিয়ায় বক্তব্য বিকৃত বা খণ্ডিতভাবে এসেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কথা ধোপে টেকে না, কারণ সবকিছুরই প্রমাণ থাকে। 

মনে আছে, প্রভাবশালী মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী ছিলেন। দলেও প্রভাব কম ছিল না।

আরও পড়ুন : কাদের মির্জা এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি 

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন হজ এবং তাবলিগ জামাত নিয়ে। জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে টাঙ্গাইল সমিতির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তারচেয়েও হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী।’

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ও সাংবাদিকদের সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন তখনকার ডাকসাইটে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। এসব বক্তব্য গণমাধ্যমে আসায় তখন লতিফ সিদ্দিকী নিজের ভুল স্বীকার না করে উল্টো গণমাধ্যমের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘গণমাধ্যম তার বক্তব্য বিকৃত এবং খণ্ডিতভাবে দিয়েছে।’

আরও পড়ুন : আওয়ামী লীগ : বহুত্ববাদ ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল 

পরে তার এসব বক্তব্যের অডিও প্রকাশ হয়। লতিফ সিদ্দিকী কী বলেছেন তা অনেকেই শুনেছেন। সবকিছুর প্রমাণ থাকলে অস্বীকার করারই বা উপায় কী! বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারান। একই সঙ্গে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। বাধ্য হন সংসদ সদস্য পদ থেকেও সরে যেতে। কেবল বেফাঁস মন্তব্যের কারণে রাজনীতির মাঠ থেকেও হারিয়ে গেলেন লতিফ সিদ্দিকীর মতো বর্ষীয়ান নেতা।

সরকারের আরেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের পরিণতিও আমরা জানি। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদে থেকে নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতেন। ২০২১ সালে ফাঁস হওয়া একটা অডিও ক্লিপে শোনা গেছে, তিনি এক নায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন। বলেছেন, হোটেলে না আসলে তাকে বিশেষ বাহিনী দিয়ে উঠিয়ে আনা হবে।

আরও পড়ুন : সমাজে নৈতিক অবক্ষয় 

কথাবার্তায় তার কী রকম দাম্ভিকতা তা ওই অডিও ক্লিপ শুনে বোঝা গেছে। ওই কথোপকথনে বোঝা গেছে, তিনি মানুষকে মানুষ মনে করতেন না। শুধু তাই নয়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়েও অশ্লীল বক্তব্য দিয়েছেন।

মুরাদ হাসানের কাণ্ডজ্ঞানহীন এসব কথাবার্তার জেরে শেষ পর্যন্ত তাকে প্রতিমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ভাগ্য ভালো, সংসদ সদস্য পদ এখনো টিকে আছে। তবে তার জোরালো গলা এখন আর শোনা যায় না।

মুখের বুলির কারণে বড় খেসারত দিতে হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমকেও। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেয়র পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বাদ দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ থেকেও।

আরও পড়ুন : মোদি বিরোধিতা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ভুলে গেলে চলবে না আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ডা. মুরাদ হাসান এবং জাহাঙ্গীর আলমের পরিণতি। বেফাঁস মন্তব্যে তারা একদিকে যেমন নিজের বিপদ ডেকেছেন অন্যদিকে তাদের দল আওয়ামী লীগও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। জনগণও তাদের তিরস্কার করেছে।

এই তিনজনের পরিণতি দেখেও ক্ষমতার চেয়ারে থাকা কারো শিক্ষা হয়নি। সরকার প্রধান কিংবা আওয়ামী লীগ প্রধান নিশ্চয় এদের শাস্তি দিয়ে অন্যদের সতর্ক করেছেন কিন্তু কারো কারো কথায় বোঝা যায় তারা এখনো সতর্ক হননি।

বাংলাদেশে যখন জ্বালানি তেলসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তখন স্বাভাবিকভাবে জনগণ ক্ষুব্ধ-বিরক্ত। এমন অবস্থায় সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের এমন মন্তব্যেরই বা কী দরকার ছিল? তিনি বলেছেন, ‘দেশের সবার গায়ে জামাকাপড় আছে, কেউতো খালি গায়ে নেই’।

আরও পড়ুন : মুরাদ হাসান : গেল গেল

কোন কথা কখন, কোথায় বলতে হবে তা মন্ত্রীদের জানা উচিত। দ্রব্যমূল্যের আগুনে যখন পুড়ছে মানুষ, জীবনযাত্রার ব্যয়ে যখন চিড়েচ্যাপ্টা দশা, মূল্যস্ফীতির চাপে যখন সংকটে দেশের অর্থনীতি তখন মন্ত্রীর এমন কথা তো কাটা গায়ে নুনের ছিটাই দেবে! বলা যায়, দেশের জনগণের সঙ্গে নিদারুণ রসিকতা।

এমন কথার রেশ না কাটতেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বললেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ নাকি বেহেশতে আছে! পরে মন্ত্রী বলেছেন, মন্ত্রীর কথা ‘টুইস্ট’ হয়েছে গণমাধ্যমে; কিন্তু ভিডিও ক্লিপে আমরা দেখেছি মন্ত্রী যেভাবে বলেছেন সেভাবে এসেছে। শিরোনাম হয়তো কেউ এদিক ওদিক করেছে কিন্তু তিনি বাংলাদেশকে বেহেশতের সঙ্গে তুলনা করেছেন এটা সত্য।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক দলের রাজনীতি 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন কথায় যখন ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে তখন আরেক বিতর্কের জন্ম দিলেন এ কে আব্দুল মোমেন। ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ভারতে গিয়ে আমি বলেছি, এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার সেটা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি।’

একজন মন্ত্রীর এমন কথায় কী ভয়াবহ ইঙ্গিত দেয়, কী রকম অস্থিরতা নিয়ে আসে তা বলা বাহুল্য! পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথা যে সরকার আর আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তিদায়ক নয় তা সহজে বলা যায়। সরকারের মন্ত্রী মোমেনের এমন কথায় সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা যায় যে, দেশে ভোটের প্রয়োজন নেই ভারত যে দলের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে সেই ক্ষমতায় আসবে।

আরও পড়ুন : যুবলীগের যে ধরনের রাজনীতি করে 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ভারত সরকারকে সত্যি সত্যি এসব কথা বলেছেন নাকি জোশে বলেছেন, তা মন্ত্রীই জানেন। মন্ত্রী এখন চাইলে এসব কথা অস্বীকার করতে পারবেন না। মিডিয়ার ওপর দোষ চাপাতে পারবেন না। তিনি যা বলেছেন তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে গেছে।

অনুগ্রহ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবার গণমাধ্যমকে দোষারোপ না করে ব্যাখ্যা করবেন ভারত সরকার কীভাবে আরেক দেশের রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে? কীভাবে সম্ভব? দেশের জনগণেরও এসব জানার আগ্রহ আছে।

তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের অতিকথন থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। বেফাঁস মন্তব্য করতে নিষেধ করেছেন কিন্তু কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্ত মানছেন না। যারা মানছেন না তারা হয়তো ভুলে গেছেন লতিফ সিদ্দিকী, মুরাদ হাসান কিংবা জাহাঙ্গীর আলমের পরিণতি।

আদিত্য আরাফাত ।। সাংবাদিক
aditya.arafat1@gmail.com