ছবি : সংগৃহীত

গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আন্দোলনের কথা প্রকাশ্যে আসছে কয়েকদিন ধরে। সেই আন্দোলন হলো, দেশের চা শ্রমিকদের আন্দোলন। দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চা শ্রমিকেরা।

বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি তারা চা বাগানে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটও পালন করছেন। সাথে আছে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ প্রতিবাদ। কিন্তু আমরা অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা তাদের এই যৌক্তিক ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সম্পর্কে জানি না বললেই চলে।

এক কথায় বলতে গেলে কিছুই জানি না। এই চা বাগানের শ্রমিকেরা স্বাধীন দেশে অনেকটা অবহেলায় বেড়ে ওঠা পরাধীন দাসের মতো। ব্যক্তি স্বার্থে সুকৌশলে তাদের এমন বানিয়ে রাখা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক।

আরও পড়ুন : চা শ্রমিক : যে জীবন দাসত্বের!

চা শ্রমিকেরা মালিক পক্ষের কাছে দৈনিক ১২০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা মজুরি দাবির স্বপক্ষে আন্দোলন শুরু করেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে ৩০০ টাকাও কিঞ্চিৎ মাত্র। এই টাকায়ও একটি পরিবারের ভরণপোষণ কষ্টসাধ্য শুধু নয়, অসাধ্যও বটে। তাই চা শ্রমিকের মজুরি ন্যূনতম দৈনিক ৫০০ টাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

দেশের যেকোনো প্রান্তের একজন সাধারণ শ্রমিক আটশত থেকে হাজার, বারোশো টাকা দৈনিক ভিত্তিতে পায়। সেই তুলনায় একই ভূমিতে বসবাস করে একজন চা বাগানের শ্রমিক পায় মাত্র ১২০ টাকা! ভাবা যায় বিষয়টি কতটা বৈষম্যের! 

দেশের চা শিল্পের ব্যাপকভাবে উন্নতি হলেও সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি অসহায় চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রায়...

দেশের সকল প্রান্তের শ্রমিকদের সাথে চা বাগানের শ্রমিকদের বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ। যুগের পরে যুগ বৈষম্যের অভিঘাতে ক্লিষ্ট হয়েই তাদের এই যৌক্তিক বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন। চা পাতা তোলার ভর মৌসুমে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে পথে নেমেছে তারা।

তাদের সাময়িক কর্মবিরতি অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে চা বাগানে হয়তো অচলাবস্থা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু এর জন্য দায়ী শ্রমিকেরা নয়, দায়ী বাগান মালিকপক্ষ। সিলেট ভ্যালির ২৩টি, হবিগঞ্জের ২৪টি ও মৌলভীবাজারের ৯২টি বাগানসহ মোট ২৪১টি চা বাগানে একযোগে এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এই সময় শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ রেখে বাগানের বিভিন্ন সেকশনে মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে তাদের উপরে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেন।

প্রাকৃতিক সুন্দরের অনন্য লীলাভূমি বৃহত্তর সিলেট। ২০১৬ সালে আগস্টের শেষ সপ্তাহে বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে যাই। শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে ফিরে দেখি। বাগানগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় শ্রমিকদের সাথে কথা বলে আমি এক অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হই।

আরও পড়ুন : মানুষ মানুষের জন্য

আমি হতবাক হয়ে যাই, চা শ্রমিকদের সাথে ঘটে চলা অমানবিকতায়। মনটা বিষাদে পূর্ণ হয়ে যায় চা শ্রমিকদের উপরে মালিকপক্ষের অমানবিক দাসসুলভ নিষ্ঠুর আচরণে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন খেটে বর্তমানে তারা মজুরি পায় মাত্র ১২০ টাকা।

বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার বা চট্টগ্রাম জেলার ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে সোয়া লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাদের অনেকেই বংশ পরম্পরায় এসব বাগানে কর্মরত আছেন। দেশের চা শিল্পের ব্যাপকভাবে উন্নতি হলেও সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি অসহায় চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রায়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশেও দাসসুলভ শ্রম শোষণের শিকার হয়ে আসছে চা শ্রমিকেরা।

সারাদিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। দ্রব্যমূল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও বাড়ে না চা শ্রমিকের আয়। সাধারণত একজন চা শ্রমিককে প্রতিদিন অন্তত ২৪ কেজি চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। চারা গাছ হলে অন্তত ১৬ কেজি পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এর বেশি সংগ্রহ করতে পারলে কেজি প্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা করে বাড়তি টাকা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন : সংকটে কেন মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত?

সন্তানদের লেখাপড়ার তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। নিজস্ব ভাষায় পড়াশোনার তেমন সুযোগ নেই। বাগানে নেই তেমন আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। বাগানে চিকিৎসা সেবা আছে, কিন্তু তা অনেকটাই নামমাত্র। কাজ করতে গিয়ে যদি কেউ আহত হয় বা কারও অঙ্গহানি ঘটে তবে নেই তেমন উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা। অধিকাংশ ঘরই সাত ফুট বাই ১৪ ফুটের। সেই ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতরভাবে বংশ পরম্পরায় বসবাস করতে হয় তাদের। 

বাংলাদেশের চা বাগানে বাগান মালিকের পক্ষে প্রতি শ্রমিককে বাগানের নির্ধারিত বরাদ্দকৃত জমিতে থাকার জন্য বাঁশ, কাঠ, টিন আর এককালীন ৪/৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই সামান্য টাকা এবং বাগান মালিকের পক্ষে দেওয়া বাঁশ, কাঠ, টিন দিয়ে ঘর শ্রমিকেরা নিজেরাই তৈরি করে নেন। 

সন্তানদের লেখাপড়ার তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। নিজস্ব ভাষায় পড়াশোনার তেমন সুযোগ নেই। বাগানে নেই তেমন আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। বাগানে চিকিৎসা সেবা আছে, কিন্তু তা অনেকটাই নামমাত্র।

পাঁচ-ছয় বা পরিবারের সদস্য যতজনই হোক বর্তমান মজুরি ১২০ টাকা দিয়েই তাদের পরিবার নির্বাহ করতে হয়। প্রতিদিন ১২০ টাকা দৈনিক মজুরির বাইরে সপ্তাহে সাড়ে তিন কেজি চাল বা আটা দেওয়া হয়। ইচ্ছা না থাকলেও ছোট ভাঙাচোরা কাঁচাপাকা ঘরে থাকতে হয় সন্তানসন্ততি নিয়ে। গবাদিপশুদেরও ঠাঁই সেখানে। তাদের জীর্ণশীর্ণ ঘরগুলো বাগান কর্তৃপক্ষের সংস্কারের আশ্বাসবাণীই শুধু দিনের পরে দিন আশ্বাসবাণীই হয়ে থাকে।

কদাচিৎ ভাগ্যচক্রে সেই আশ্বাসবাণী আলোর মুখ দেখে। তাদের নেই কোনো নিজস্ব জমি বা ভিটেমাটি। বাগানে কাজ না করলে বা বাগান মালিকের বিরুদ্ধে কথা বললে মাথা গোঁজার আশ্রয়ও চলে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই এই অসহায় মানুষগুলো চাইলেও মুখ খুলতে পারে না। প্রতিবাদ করতে পারে না। সেই সুযোগেই তাদের ওপর চলে বঞ্চনার অভিঘাত যুগের পরে যুগ।

আরও পড়ুন : কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

নিদারুণ দুঃখ দুর্দশাই যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। দুর্দশাময় দাসের মতো জীবনযাপন করেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চা শিল্পকে ধরে রেখেছেন চা শ্রমিকেরা, যাদের চা শিল্পী বললেও কোনো অংশে ভুল হয় না।

অর্থনৈতিক দারিদ্র্যতায় পুষ্টিকর খাবার দূরে থাক, সাধারণ ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতেই তাদের কষ্ট হয়ে যায়। তিন বেলা খাবারেই থাকে চায়ের পাতা। সকালে চা মুড়ি, দুপুরে রুটির সাথে চা পাতার ভর্তা। রাতে হয়তো ডাল ভাত আর আশেপাশের ক্ষেতখামার বা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কচু শাক। এভাবেই কেটে যায় তাদের দিনের পর দিন।

মাছ বা মাংস মাসে একদিন, কখনো দুই মাসে একদিন হয়তো ভাগ্যে জোটে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ১২০ টাকা দিয়ে সবজি, মাছ, তেল, লবণ, ডাল, সাবান, চিকিৎসা ব্যয়, পোশাক, প্রসাধনী, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে একজন চা শ্রমিকের সংসার চালানো আর কোনোমতেই সম্ভব নয়। 

হতভাগ্য চা শ্রমিকদের ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩০-এর দশকে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে তৎকালীন অখণ্ড বঙ্গের পূর্বাংশে এনেছিল চা কোম্পানির মালিকেরা। কম দামে শ্রম কিনে অধিক মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্যে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশলে  আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে।

 

আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মাদ্রাজ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, উত্তরপ্রদেশসহ কয়েকটি অঞ্চল থেকে চা শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয় বাংলার পূর্বাংশে ব্রিটিশ আমলে। সেই শ্রমিকদের বেশিরভাগ ছিল অত্যন্ত গরিব এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।

দালালেরা তাদের ভালো চাকরি এবং উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসে। কানু, তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধের সময় বহু মুক্তিযোদ্ধা বৃহত্তর সিলেটের এসব বাগানে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। সেই সময় এই চা শ্রমিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েও সহায়তা করেন।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নিযুক্ত দালালেরা সহজ সরল মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বলে, গাছ নাড়লেই টাকা আসবে, যত গাছ নাড়বে ততই টাকা। এমন প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে সরল চা শ্রমিকেরা এই অঞ্চলে আসে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তারা এসে দেখে, গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো জীবন রক্ষাই দায়।

একদিকে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, অন্যদিকে জঙ্গলাকীর্ণ হিংস্র শ্বাপদ প্রাণীর প্রতিকূল পরিবেশ। পাহাড়-জঙ্গলময় পরিবেশে সমৃদ্ধির উচ্চাভিলাষ দূরে থাক, জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায় তাদের কাছে।

১৮৬৫ এবং ১৮৮২ সালে এমন আইন করে ব্রিটিশ সরকার, যার ফলে কোনো শ্রমিক বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই যখন-তখন বন্দি করে রাখতে পারবে বাগান মালিকেরা। শ্রমিকদের মারধর করা, আটকে রাখা বা প্রকারান্তরে অপহরণ করা একপ্রকার আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।

চা বাগানের ম্যানেজার এই অসহায় মানুষগুলোর ওপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার লাভ করে। কোনো শ্রমিক ইচ্ছা করলেই স্বেচ্ছায় চাকরি ত্যাগ করতে পারতো না। যেন মানব দাসত্বের এক ভয়ংকর গুহা। যে গুহায় প্রবেশের পথ রয়েছে, কিন্তু বের হওয়ার পথ নেই।

চা বাগান থেকে কোনো শ্রমিক পালিয়ে গেলে, তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। বারবার খোঁজ করে তাদের পুনরায় ধরে আনা হতো। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে দেওয়া হতো অমানবিক শাস্তি। চা বাগানের মনিব, ম্যানেজার বা কর্মকর্তাদের চাবুক-বুটের-লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

আরও পড়ুন : দুঃখী মানুষের বাজেটের সন্ধানে 

নির্মম অমানবিক অত্যাচারে মালিকদের হাতে আহত ক্ষতবিক্ষত হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু ছিল একটি নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। মালিকদের কথায় বাগানে রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছুই ছিল না। বাগানের ভেতরে মনিবের সামনে দূরে থাক, ছাতা মাথায় হাঁটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো।

ব্রিটিশ সরকারে বিরুদ্ধে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই অমানবিক পরিবেশে অতিষ্ঠ চা শ্রমিকেরা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ১৯২১ সালে ২০ মে ১২,০০০ চা শ্রমিক জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট ও আসামের বিভিন্ন বাগান থেকে এসে চাঁদপুরে জড়ো হয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, চাঁদপুর থেকে স্টিমারে করে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পৌঁছে পরবর্তীতে রেলযোগে তাদের যার যার জন্মভূমিতে ফিরে যাবেন। কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

তাদের জন্মভূমিতে ফেরায় বাধা প্রদান করে তখনকার ইউরোপিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন ও স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট। তাড়াহুড়ো করে স্টিমারে উঠতে গিয়ে অনেক শ্রমিকই পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বাকি শ্রমিকেরা আর বাগানে না ফিরে চাঁদপুরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিধি বাম! অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে তাদের মধ্যে কলেরা রোগ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে যায়।

তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা শ্রমিকদের দমনের এক মোক্ষম সুযোগ পায়। তারা কলেরা ঠেকানোর নামে শ্রমিক বিদ্রোহ দমন শুরু করেন। শ্রমিকদের দমন করতে গোর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়। গোর্খা সৈন্যরা এসে রাতের বেলায় অসহায় নিরস্ত্র চা শ্রমিকদের ওপরে হামলা করে এবং গুলি চালায়। সেদিনই প্রায় ৩০০ নিরস্ত্র চা শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনার পর থেকে আর কখনো নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেনি অসহায় ভাগ্য বিড়ম্বিত চা শ্রমিকেরা।

আরও পড়ুন : সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের সর্বশেষ দলটি আসে ১৯৪৬ সালে, ভারতের তেলেগু ভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর সিলেট ও চট্টগ্রামের চা শ্রমিকেরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। এরপর থেকে তাদের বংশধররাই এখনো দেশের বিভিন্ন চা বাগানগুলোতে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কাজ করে যাচ্ছেন। কয়েক প্রজন্ম পূর্বে তারা ভারতের মধ্য, উত্তর এবং দক্ষিণের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসলেও, বর্তমানে তারা এই ভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ আপন করে নিয়েছেন।

এই ভূমি এবং এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে তারা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উজাড় করে দিয়েছেন। কখনো কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধের সময় বহু মুক্তিযোদ্ধা বৃহত্তর সিলেটের এসব বাগানে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। সেই সময় এই চা শ্রমিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েও সহায়তা করেন।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে, মধ্যবর্তী পাকিস্তান শাসনামল পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও হতভাগ্য চা-বাগান শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। রাশি রাশি অবহেলার ধূলায় ধূসর রঙের হয়ে আছে তাদের যাপিত জীবন।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করলেও, চা-বাগান শ্রমিকদের জীবনে নেই কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন। যতটুকু হয়েছে, তা সকলই দায়সারাভাবে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও, বিশেষ করে নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভ থেকেও বঞ্চিত। তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অথচ তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষায় নেই কোনো যথাযথ পদক্ষেপ। অথচ এর বিপরীতে আছে, তাদের অবদমিত করে রাখতে মালিকপক্ষের বিবিধ প্রকারের অমানবিক অপকৌশল।

আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায় 

চা বাগানের পূর্ববর্তী বৈদেশিক ব্রিটিশ মালিক থেকে বর্তমান স্বদেশি মালিক-শ্রমিক শোষণের ক্ষেত্রে উভয়েরই সাদৃশ্য অতুলনীয়। মালিকপক্ষের খুব একটা পরিবর্তন আসেনি বললেই চলে। মালিকপক্ষের হয়তো জাতিগত পরিচয় পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকের অধিকার প্রশ্নে স্বভাব চরিত্র সেই পূর্বেরই রয়েছে।

নিজের অধিকার নিয়ে যেন চা বাগান শ্রমিকেরা সোচ্চার না হতে পারে, তাই মালিকপক্ষের জ্ঞাতসারে শ্রমিকদের মদের নেশার ঘোরে রাখতে সাহায্য সহযোগিতা করা হয় বলে জনশ্রুতি। এই কারণেই পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে মদের দোকান। গাঁজা গাছের পাতাও বাগানগুলোতে সহজলভ্য।

মালিকপক্ষের জ্ঞাতসারেই সহজ সরল অসহায় শ্রমিকদের নেশার ঘোরের মধ্যে রেখে চালানো হয় বংশানুক্রমিক শ্রমদাস প্রথা। এই বংশানুক্রমিক শ্রমদাসের জাল ছিন্ন করে দুই একজন যারা ডাক্তার হচ্ছেন, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তারাও একটি পর্যায়ে গিয়ে নিজের জীবন এবং নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নিমগ্ন হয়ে চা বাগানের এই বৃহত্তর স্বজাতি জনগোষ্ঠীর সাথে আর তেমন যোগাযোগ রাখেন না বলেই অভিযোগ। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে এর ব্যতিক্রমও দুই একজন আছেন, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে নির্যাতিত চা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়