ছবি : সংগৃহীত

কিছুদিন আগে শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার গিয়েছিলাম একটি আন্তর্জাতিক এনজিও’র প্রোজেক্ট ইভ্যালুয়েশন টিমের সাথে। কুষ্ঠ রোগ নিয়ে প্রজেক্ট ছিল। এর আগে চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়নি।

শুধু ছবিতে দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি তাদের চা পাতা তোলার নান্দনিক কৌশল দেখে। কিন্তু চারদিন ধরে তাদের সাথে কাজ করে জেনেছি, বুঝেছি চা পাতা তুলতে কত কষ্ট এবং তাদের কষ্টের জীবনের নানা কথা। জেনেছি, শত বছরের শোষণের শিকার হতদরিদ্র চা শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়ার গল্প।

সকালে এক কাপ চা পান না করলে অনেকের দিনই শুরু হয় না। সকল থেকে রাত অবধি কাজের ফাঁকে চা যেন অপরিহার্য। আবার ক্লান্তি দূর করতে চায়ের জুড়ি নেই।

পাশাপাশি, অতিথি আপ্যায়ন বা আড্ডা জমাতে চা যেন আবশ্যিক অনুষঙ্গ। কখনো কখনো শহুরে জীবনে চা ছাড়া এক ধরনের বিলাসিতা যেন অপূর্ণ থেকে যায়। যেমন কে, কোথায় এবং কত দামের চায়ে আপ্যায়িত করল।

আরও পড়ুন : চা শ্রমিক : যে জীবন দাসত্বের!

রাজধানীসহ সারাদেশেই এখন বাহারি চায়ের পসরা বসে। চা কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও শুধু চা নিয়েই ব্যবসায়িক সমাগম।

চায়ের জন্যই হাট-বাজার। দুধ চা, রং চা, লেবু চা, আদা চা, মশলা চা, মাল্টা চা, আপেল চা, তেঁতুল চা এবং মরিচ চা এমন অসংখ্য চা পরিবেশিত হচ্ছে। পাঁচ তারকা হোটেলে এক কাপ চা ৬০০ থেকে হাজার টাকায় পরিবেশিত হয়।

দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য চা নিয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চা অনেক মূল্যবান। আর ব্রিটিশ আমল থেকেই চা রপ্তানিতে আমাদের সুনাম আছে।

আমরা জানি না সেই এক কাপ চায়ের জন্য কী পরিমাণ চা পাতা তুলতে হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কত কষ্টে চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। হাড্ডিসার ক্লান্ত দেহ দিনের শেষে কত টাকা পারিশ্রমিক পায় তা ছিল আমাদের জানার বাইরে।

আরও পড়ুন : মানুষ মানুষের জন্য

শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জেনেছি, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। অর্থাৎ ১২০×২৬= ৩১২০ টাকা মাসে আয় হবে যদি একজন শ্রমিক প্রতিদিন ২৪ কেজি চা পাতা তুলতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের মেয়েরাই শুধু পাতা তোলার কাজ করবে, আবার একই পরিবারের দুজনের বেশি কাজ করতে পারবে না। 

বেশিরভাগ শ্রমিকই তিন বেলা পেট ভরে খেতে পান না। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাসস্থান, নিরক্ষরতা, অসচেতনতা যেন চা শ্রমিকদের জন্যই। আবার, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। অনেকেই সঠিক চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত।

নাগরিক সুবিধা বা অধিকার যেন চা শ্রমিকদের জন্য নয়। অধিকার বঞ্চিত এই মানুষগুলো সবসময়ই থাকে আমাদের ভাবনা ও দৃষ্টির আড়ালে।

আরও পড়ুন : সংকটে কেন মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত?

দুপুরে এক থালা ভাতের সাথে চা পাতা দিয়ে এক ধরনের ভর্তা তাদের প্রধান খাদ্য। আমার কৌতূহল মেটাতে এক নারী একটু চা পাতা ভর্তা আমাকে খেতে দিয়েছিলেন। এই ভর্তাকে কখনোই সুস্বাদু বলা যায় না।

এভাবেই তারা পুষ্টিহীনতায় দিনে দিনে আরও রুগ্ন হচ্ছেন। চা শ্রমিকদের চেহারা দেখলেই মনে হবে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা হারিয়ে নানা রোগের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন তারা।

হতভাগ্য চা শ্রমিকদের কাছ জীবন মানেই যেন দিনটি পার করে দেওয়া। প্রতিনিয়ত ‘ভালো আছি’ বলে বেড়ানো এই মানুষগুলোর জীবনে যেন রং নেই। আছে না পাওয়ার চরম হতাশা। আসলে স্বপ্ন দেখার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন তারা।

শত বছরের শোষণের শিকার চা শ্রমিকেরা সম্প্রতি আন্দোলনে নেমেছেন। স্বপ্নের মতো সাহস দেখাচ্ছেন তারা। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকার স্থলে ৩০০ টাকা দাবি তাদের।

আসলে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির এই বাস্তবতায় দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিও যথেষ্ট নয়। ৩/৪ জনের পরিবারের জন্য তাদের এই চাওয়া সুখ এনে দিতে পারবে না।

আরও পড়ুন : কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

চা রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। চা বাগানের মালিকেরা নতুন নতুন গাড়ি কিনছেন। পুরোনো হওয়ার আগেই বদল করছেন বাড়ি। অথচ, শ্রমিকদের জন্য যেন কোনো দরদ নেই তাদের।

বন্ধুদের সাথে আড্ডায় একদিনে যা খরচ করেন তা হয়তো শ্রমিকদের পুরো মাসের আয়ের চেয়েও বেশি। চা বাগান মালিকদের সন্তানেরা একদিনে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে তা হয়তো শ্রমিকদের সন্তানেরা চোখেও দেখে না। আর উৎসব আয়োজনে নতুন পোশাক যেন ভাবতেও পারে না চা শ্রমিকেরা।

বিলাসিতা নয়, শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যই রাজপথে নেমেছেন চা শ্রমিকেরা। বর্তমান বাজারে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা পেলে শ্রমিকদের জীবনে কখনোই বাড়ি-গাড়ি হবে না। তবে দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা মিলবে। চা শ্রমিকদের নিষ্পাপ শিশুদের মুখে হাসি ফুটবে।

সবাই এগিয়ে আসুন, চা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবিতে সমর্থন দিন। চা শ্রমিকদের মুখে হাসি দেখতে চাই।

সৈয়দা হুমায়রা হেনা ।। সাধারণ সম্পাদক, ইচ্ছাশৈলি নারী ফাউন্ডেশন