ছবি : সংগৃহীত

ভাসানচর। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ত্রিশ হাজার মানুষ এখানে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে এক লাখ মানুষের আবাস তৈরি করা হয় মেঘনা মোহনার দ্বীপে। নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আধুনিক মানের এই আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা হয়।

দ্বীপ টেকসই করতে উপযুক্ত বাঁধ দেওয়া হয়। প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অন্যদিকে সুপেয় পানি থেকে শুরু করে জীবন ধারণের সব উপকরণ আছে এই দ্বীপে। এক লাখ মানুষের বসবাস, পয়ঃনিষ্কাশন, শিশুদের জন্য স্কুল, বিনোদনের ব্যবস্থা, মসজিদসহ সবকিছুই প্রস্তুত করা হয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে।

পর্যায়ক্রমে ভাসানচরে ৩ লাখ মানুষের আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে কিছু মানুষ সরিয়ে আনা। যাতে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা একটু সহজ হয়।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বাস্তবতা

আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল তারপর থেকে। কক্সবাজারের ওই অস্থির আর ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে তারা শান্তিপূর্ণ আর খোলামেলা পরিবেশে আসতে চাইবে এমনটাই হওয়ার কথা। হঠাৎ জানা গেল, রোহিঙ্গারা ভাসানচরে আসতে চাইছে না। বিষয়টি নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছিল বাংলাদেশ।

একটি দেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা কোথায় থাকবে সেটা সেই রাষ্ট্রই ঠিক করবে। কিন্তু শরণার্থীদের মত নিয়েই সেটি করতে হবে। নিয়ম, আইন ও রীতি অনুযায়ী এটাই হওয়ার কথা। আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকেরা আসতে না চাইলে তাদের জোর করা যাবে না, এটাই নিয়ম। আর সেই সুযোগ নেয় একটি মহল।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হচ্ছে;   ছবি : মোহসীন-উল হাকিম

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্পে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। ওখানে গেলে আর ফেরা যাবে না। ভাসানচর গভীর সাগরে ডুবে যাবে। সেখানে গেলে ডুবে মরতে হবে। এই ধরনের অপপ্রচার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। এরপরেও যারা আসতে চায় তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়।

আরও পড়ুন : মিয়ানমারে তথ্যপাচার, দেখবে কে? 

মূলত রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত আরসা’র বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে যাতে কেউ ভাসানচরে যেতে রাজি না হয়। শুধু তাই নয় ভার্চুয়াল মাধ্যমে অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ে। অথচ ভাসানচর বসবাসের জন্য উপযোগী একটি দ্বীপ ভূমি।

অফ দ্য রেকর্ডে রোহিঙ্গাদের নেতা মুহিবুল্লাহ বললেন, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর চাইছে না...

হাজার বছর আগে জেগে ওঠা এই চরের পূর্ব পাশে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ আর পশ্চিম পাশে নোয়াখালীর হাতিয়া। উত্তর পাশে আছে স্বর্ণদ্বীপ। যেখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আর ভাসানচরেই থাকবে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর অবস্থান। সব মিলিয়ে বসবাসের জন্য অত্যন্ত উপযোগী জায়গা। কিন্তু অপপ্রচারে যেন রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সব আয়োজন ভেস্তে যেতে বসেছিল।

ভাসানচর প্রস্তুত হওয়ার পর সেখানে প্রথম সাংবাদিক হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। পানি পথে ছোট্ট একটি মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে গেছি সেখানে। আবহাওয়া বৈরী থাকলেও যেতে কোনো সমস্যা হয়নি। সারাদিন কাজ করেছি। ঘুরে দেখেছি। ফিরে এসে প্রতিবেদন করেছি।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা ইস্যু: সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

নিজের চোখে দেখা ভাসানচর নিয়ে করা প্রতিবেদন আলোচনায় এসেছিল। এরপর দেশের জাতীয় দৈনিক, অনলাইন ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা সেখানে গেছেন। প্রতিবেদন করেছেন। সেখানে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সবকিছুই তুলে ধরেন সাংবাদিকেরা।

এর আগে ও পরে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছি, রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ভাসানচর নিয়ে তাদের ভুল ভেঙেছে ততদিনে। কিন্তু কোনো একটি মহলের চাপে কেউ মুখ খুলতে চাইছিলেন না।

অফ দ্য রেকর্ডে রোহিঙ্গাদের নেতা মুহিবুল্লাহ বললেন, আরসা থেকে হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছে। বললেন, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর চাইছে না। এরপর কক্সবাজারের একটি বড় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। অফ দ্য রেকর্ডে তিনিও জানালেন ভাসানচরে তারা যেতে চান না।

আরও পড়ুন : সর্বজনীন মানবাধিকারের দাবি সু চির পতনের শিক্ষা

এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা বাস্ত্যুচ্যুত নাগরিকদের বোঝানোর চেষ্টা চলছিল। তার ধারাবাহিকতায় কয়েক ধাপে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে ভাসানচরে। শুরু থেকে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো আর আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর অনীহা ছিল।

তখন স্থানীয় ২২টি এনজিও সেখানে কাজ শুরু করে। যদিও পরবর্তীতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভাসানচরে বসবাসরত আশ্রিতদের মানবিক সহযোগিতা দিতে সম্মত হয়েছে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হচ্ছে;   ছবি : মোহসীন-উল হাকিম

এবার অন্য প্রসঙ্গ। এগারো লাখ রোহিঙ্গাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। বছরের পর বছর তাদের অবস্থান কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্থানীয়রা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে আর্থসামাজিক সংকটে পড়েছে কক্সবাজার, বাংলাদেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তা ইস্যু।

আল-ইয়াকিন নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের ভেতরে সক্রিয় ছিল। পরবর্তীতে আরসা নামে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার নেতৃত্ব আছেন আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। এই সংগঠনের অপতৎপতার জবাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হামলা চালিয়েছিল রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর।

আরও পড়ুন : মুহিবুল্লাহ হত্যা : রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ ও অস্থিরতা 

গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এদেশে ঢুকে পড়েছিল সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা। এরপর নামে বেনামে আরসা কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এদেশে ঢুকে পড়েছিল সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা।

একটা সময় এসে এদের দাপটে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আতঙ্কে থাকতে হতো। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শরণার্থী শিবিরে দিনের বেলা চলে সরকারের শাসন, আর রাতের বেলা চলে সন্ত্রাসী অর্থাৎ আরসা সন্ত্রাসীদের শাসন।

একের পর এক হত্যা, অপহরণসহ নানা অপকর্ম চলতে থাকে। মুহিবুল্লাহ বলেছিলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে বাংলাদেশ সরকারে সমর্থন দেওয়ায় তার উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলায় আরসা থেকে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি শরণার্থী শিবিরে রাতের বেলায়ও পুলিশি নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি করেছিলেন।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা সংকট : ক্ষতের গভীরতা কতটা মাপতে পারছি?

রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহর নির্দেশে ৩৪টি ক্যাম্পের ব্লকে ব্লকে ৭ সদস্যের একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আরসার পক্ষ থেকে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ রাতে উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ভেতরে বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে মুহিবুল্লাহকে।

বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এই ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা বিধানে দায়িত্ব পালন করছে। গোয়েন্দা তৎপরতাও চলছে। তবে এর মধ্য দিয়েও চলছে সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড। চলছে হাজার কোটি টাকার কারবার ইয়াবার ব্যবসা। অন্যদিকে সীমান্ত হয়ে পড়েছে নানা কারণে স্পর্শকাতর। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক মহলের সাড়া না পাওয়ায় এই সংকট দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে।

সমাধান সবাই চায়। রোহিঙ্গারাও দেশে ফিরতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে আশানুরূপ কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি এখনো পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা আশানুরূপ না। বাংলাদেশও এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি যার জন্য মিয়ানমার হওয়ায় এই সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল। তবে এটুকু বুঝতে পারি, সামনে অনেক বিপদ অপেক্ষা করছে।

আরও পড়ুন : আরসা’র অস্তিত্ব ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা 

আমি মনে করে, সাংবাদিক হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে পর্যাপ্ত মানসম্মত কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। কিছু কাজ হচ্ছে তবে সংকটের গুরুত্ব অনুযায়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঘাটতি আছে এখানে। সেই দায় নিয়ে বলছি, সংকটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের স্বরূপ উন্মোচন, এর সমাধানে দায়িত্বশীলদের ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ আছে? আমি সন্তুষ্ট নই।

মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক এই সীমানা আঞ্চলিক কারণে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, কৌশলগত কারণে কক্সবাজার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট হলে সেই সুযোগ নিতে পারে অপশক্তিরা। অবৈধ মাদকের কারবার, চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্রের কারবার তো আছেই এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নিরাপত্তা সংকট।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিবেচনায় এই অঞ্চল সবসময় ঝুঁকির মধ্যে আছে। সামাল দিতে না পারলে এই ঝুঁকি বাংলাদেশকে ভোগাবে সন্দেহ নেই।

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন