বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫) নোয়াখালীর স্থানীয় সাংবাদিক। মুজাক্কির দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তাবাজারের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি। মুজাক্কিরকে জীবন দিতে হয়েছে ক্ষমতালোভী দখলদার রাজনীতিবিদদের হাতে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট বর্তমান সময়ের আলোচিত একটি নাম।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার কিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডই এই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে নিজ দলের স্থানীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের নিয়ে মন্তব্য করে তিনি সত্যবাদী হতে চেয়েছিলেন। গত নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। অনেকেই তার ঐ বক্তব্যের পর তাকে বাহবা দিয়ে বীরপুরুষ বানিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতায় তিনি হলেন চরম স্বার্থপর একজন রাজনীতিবিদ।

মুজাক্কিরের মৃত্যু দেশের মানুষের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে জানি না, তবে তার মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ক্ষমতা দখলের রাজনীতির জন্য, নিজের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। নির্লজ্জ ক্ষমতা দখলের কাছে জীবন উৎসর্গ করতে হল মুজাক্কিরকে।

যদি ওবায়দুল কাদের তার ভাইকে পেছন থেকে শক্তির জোগান না দিতেন তা হলে তাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চাপরাশিরহাট বাজারে মেয়র কাদের মির্জার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল। বাদলের মিছিলটি চাপরাশিরহাট বাজারে গেলে মির্জার অনুসারীরা হামলা চালান। তখন গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫)। গত শনিবার রাতে তিনি রাজধানীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মুজাক্কিরের মৃত্যু দেশের মানুষের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে জানি না, তবে তার মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ক্ষমতা দখলের রাজনীতির জন্য, নিজের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। নির্লজ্জ ক্ষমতা দখলের কাছে জীবন উৎসর্গ করতে হল মুজাক্কিরকে।

২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শাহজাদপুরের মনিরামপুরে তৎকালীন পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মিরুর বাড়ির সামনে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দৈনিক সমকালের শাহাজাদপুর প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে মিরু সহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। পরবর্তীতে পুলিশ মিরু সহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বর্তমানে সবাই জামিনে মুক্ত।

বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন একটা মামুলি ব্যাপার। কারো ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগলেই নির্যাতনের শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। বিশেষ করে মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রাণ দিতে হয় বেশি। হত্যা, নির্যাতনের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর অফিসে ঢুকে পত্রিকাটির বিশেষ প্রতিনিধি শামছুর রহমানকে হত্যা করা হয়। ১৭ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যশোর টাউন হলে এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘শামছুর রহমানের খুনিদের সাত হাত মাটির নিচ থেকে বের করে তাদের বিচার করবো।’

তারপর একে একে খুন হন মানিক সাহা, আবদুল লতিফ পাপ্পু, হুমায়ূন কবির বালু, বেলাল হোসেন, গৌতম দাস সহ অনেক স্থানীয় সাংবাদিক। তবে আজও দেশে সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। সাগর-রুনি হত্যার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টায় খুনিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’

বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন একটা মামুলি ব্যাপার। কারো ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগলেই নির্যানের শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। বিশেষ করে মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রাণ দিতে হয় বেশি। হত্যা, নির্যাতনের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪৮ ঘণ্টা, ৪৮ দিন, ৪৮ মাস বহু আগেই শেষ হয়েছে কিন্তু সাগর-রুনির হত্যাকারীরা আজো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যায় তার বাবা নুরুল হুদা ওরফে নোয়াব আলী মাস্টার বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতে চাই, এখানে আসামিরা কেন অজ্ঞাতনামা হবে? যেহেতু এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই স্থানীয় নেতার সন্ত্রাসীরা নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে এই সংঘর্ষ করেছে, উচিত হলো স্থানীয় আওয়ামী লীগের ঐ দুই নেতা-কর্মীর সমর্থকদের আসামি করা এবং গ্রেফতার করা।

আমরা দেখি বিরোধী দলের ডাকা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে পঞ্চগড় কিংবা টেকনাফে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে ঢাকায় থাকা কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাদের গ্রেফতার করা হয়। অথচ একজন সাংবাদিককে হত্যার পরও তার হত্যার আসামি গ্রেফতার হয় না। তার জন্য সাংবাদিকদের একটি বড় অংশেরও দায় কম নয়।

সবাই খুব ভালো ভাবেই জানেন মুজাক্কিরের খুনি কারা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যতই চেষ্টা করুক না কেন মুজাক্কির হত্যা মামলার দায় এড়াতে পারে না। এই দায় সাংবাদিকদের, এই দায় সবার।

ওয়াসিম ফারুক ।। কলামিস্ট

woashim76@gmail.com