জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দেওয়া বীর উত্তম পদক তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছুদিন থেকেই পত্রপত্রিকায় এবং বৈদ্যুতিক প্রচারমাধ্যমে লেখালেখি ও কথাবার্তা চলছে দুপক্ষেই। জিয়াউর রহমানের পদক তুলে নেওয়ার ব্যাপারে যে দুটি বিষয় সামনে এসেছে তা হলো―

(১) জিয়াউর রহমান আসলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। সে মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মবেশে ভারতে বসে পাকিস্তানি চর হিসেবে কাজ করেছে।

(২) জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হওয়ায় এবং হত্যার পর সংবিধান ও দেশের আইন লঙ্ঘন করে ক্ষমতা জবরদখল করায় সে বীর উত্তম পদকের দাবিদার থাকতে পারে না।

প্রথমেই বঙ্গবন্ধু হত্যায় এবং তার ধারাবাহিকতায় জিয়ার ভূমিকার কথা দিয়ে শুরু করতে চাই।

জিয়া যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল খলনায়ক ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ এসেছে তার থেকেই এ দাবি দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। সে মামলায় একটি ভিডিও দাখিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। ভিডিওতে লন্ডনভিত্তিক এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে, সেখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। উক্ত সাক্ষাৎকারে ফারুক এবং রশিদ উভয়েই বলেছেন, যে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে যখন জিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন, জিয়া তখন তাদের বলেছিল, ‘তোমরা চালিয়ে যাও, আমি তোমাদের সাথে আছি।’

একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জিয়ার তখন আইনি দায়িত্ব ছিল ফারুক-রশিদকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। সেটা না করে জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যায় উসকানিদাতার ভূমিকা পালন করেছে। সেদিন যদি জিয়া, ফারুক-রশিদকে পুলিশে দিত, তাহলে সকল ষড়যন্ত্র ধরা পড়ত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না। ইতিহাস অন্যরকম হতো। সেই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালি জনতাই শুধু দেখেননি, দেখেছিল বিভিন্ন দেশের বহুজন।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় ফারুকের স্বাক্ষরসহ এক লেখায় ফারুক যেসব কথা উল্লেখ করেছিল নিচে তার কিছু পুনর্মুদ্রণ করছি বাংলা অনুবাদ করে, ‘গত আগস্ট মাসে আমার সহকর্মী এবং শ্যালক কর্নেল আব্দুর রশিদের প্রস্তাবানুসারে মুজিবের পরিবর্তে প্রবীণ রাজনীতিবিদ খন্দকার মোশতাক আহমদকে প্রেসিডেন্ট পদে বসাতে সম্মত হই, একই সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে পীড়াপীড়ি করি। আমি ভাবি যে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবের হাতে নিগৃহীত এবং তার হাতে যে চরম অবহেলার পাত্র হয়েছে সেই সেনাবাহিনীকে তিনি (জিয়া) ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারবেন। এ কাজ হাতে নিয়ে তাদের তা জানাই। জনাব মোশতাক এবং জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে একমত নন।’

সেদিন যদি জিয়া, ফারুক-রশিদকে পুলিশে দিত, তাহলে সকল ষড়যন্ত্র ধরা পড়ত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না। ইতিহাস অন্যরকম হতো।

এই মামলার ৯ নং সাক্ষী কর্নেল হামিদের জবানবন্দি নিশ্চিত করেছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে জিয়া খুনি ডালিম ও নূরের সাথে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের টেনিস গ্রাউন্ডে একত্রে ছিল। কর্নেল হামিদ তার সাক্ষ্যতে বলেছিলেন, ‘১৪ আগস্ট (১৯৭১ সাল) বিকাল বেলা জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল মামুন, কর্নেল মোরশেদ এবং আমি টেনিস খেলছিলাম। তখন আমি লক্ষ্য করলাম চাকরিচ্যুত মেজর ডালিম এবং মেজর নূর টেনিস কোর্টের আশেপাশে ঘোরাফেরা করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে এদের দুজনকে ওই আগস্টের প্রথম হইতে এরূপভাবে টেনিস কোর্টের আশেপাশে দেখতে পাই। ইহা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়, কারণ তারা ছিল চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। একদিন জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলিলেন, এরা চাকরিচ্যুত ও জুনিয়র অফিসার, এরা কেন এখানে টেনিস খেলতে আসে? এদেরকে মানা করিয়া দিবেন- এখানে যেন না আসে। খেলা শেষে আমি মেজর নূরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমরা কার অনুমতি নিয়া এখানে খেলিতে আস? জবাবে জানালেন, ‘আমরা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়া আসি।’

মামলার ৪৪ নং সাক্ষী কর্নেল সাফায়েত জামিল তার সাক্ষ্যতে বলেছিলেন, ‘আমি দ্রুত ইউনিফর্ম পরিয়া মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দেই। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যাই এবং তাহাকে শেভরত অবস্থায় পাই। আমার নিকট হইতে ঘটনা শোনার পর তিনি (জিয়া) বলিলেন, ‘So what? President is killed, Vice President is there’, (প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে, তাতে কি? ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছে।’)

৪৫ নং সাক্ষী হিসেবে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘১৫/২০ মিনিটের মধ্যে তাহারা আমার বাসায় আসিয়া পড়ে। জিয়া ইউনিফর্ম ও শেভ করা এবং খালেদ মোশাররফ নাইট ড্রেসে নিজের গাড়িতে আসে। এক পর্যায়ে আমার ডেপুটি চিফ (জিয়া) আমাকে বলিলেন ‘Don’t send him, (খালেদ মোশাররফ) he is going to spoil it’ জেনারেল সফিউল্লাহ আরও বলেছিলেন, আমি অনুমতি দিলে শাফায়াত তাহার ব্রিগেড মেজর হাফিজকে নিয়া আমার রুমে ঢুকে এবং বসতে বলে Sir don’t trust your deputy, (জিয়া), he is behind all these things (হত্যার পেছনে) আমি তাহাকে বলিলাম, এ কথাগুলি বলিতে তোমার এতদিন সময় লাগিল।’

জেনারেল সফিউল্লাহ আরও বলেছিলেন, ‘এরপর ১৮ তারিখ (১৯৭১-এর ১৮ আগস্ট) পর্যন্ত একই কাপড়ে বঙ্গভবনে থাকিতে বাধ্য হই। এই কয়দিন ডেপুটি চিফ জিয়া, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমানকে বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করিতে দেখিয়াছি।’

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী নামক এক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা, যিনি এই মামলার সাক্ষী ছিলেন না, তিনি, ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক (১৯৭১-১৯৮১)’ বইতে লিখেছেন যে, তিনি জিয়ার বাড়িতে কর্নেল ফারুককে দেখে অবাক হয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জিয়া কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

ওপরের সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে নিরঙ্কুশ বলা যায় জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার মুখ্য ভূমিকায় ছিল। পরবর্তীতে খুনিদের রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি আইন করে এবং তাদের পদোন্নতি দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে আকর্ষণীয় চাকরি দিয়ে জিয়া আরও শক্তভাবে প্রমাণ করেছে সে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিল।

বহু বছর পালিয়ে থাকার পর ধরা পড়ে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তার মৃত্যু পূর্ব ঘোষণায় খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ বলেছিল, ‘এই খুনের পেছনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল জিয়াউর রহমান।’

পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় প্রদানকালে হাইকোর্টের সে সময়ের মাননীয় বিচারপতি খায়রুল হক (পরে দেশের প্রধান বিচারপতি) তার লিখিত রায়ে যা লিখেছেন, বাংলা অনুবাদে তা নিম্নরূপ:

‘এটা বিশ্বাস অযোগ্য যে একজন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সায়েম এবং বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জানতেন না যে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ মতে তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, তারপরও তারা সকলেই, সংবিধান ভঙ্গ এবং লঙ্ঘন করে বল প্রয়োগ দ্বারা রাষ্ট্রপতির গদি দখল করেছিল বলে দৃশ্যত তারা সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে।’

বহু বছর পালিয়ে থাকার পর ধরা পড়ে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তার মৃত্যুপূর্ব ঘোষণায় খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ বলেছিল, ‘এই খুনের পেছনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল জিয়াউর রহমান।’

এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ১৬ সংশোধনী মামলায় তার দেয়া রায়ে লিখেছেন, ‘বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে বাতিল করে আরও ভয়ঙ্কর কাজ করেন এবং ২৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ তারিখে একজন আর্মি রুলস ভঙ্গকারী সরকারি কর্মচারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়ে দেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তিনি (সায়েম) যেন তখন ইচ্ছা পোষণ করলে একজন ডাকাতকেও দেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়ে দিতে পারতেন। দেশের জনগণের তখন কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা ছিল না। জনগণ অবাক হয়ে দেখল যিনি সংবিধান ও দেশকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলেন বা যে বিভাগটিকে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল তিনি এবং তারা সংবিধান তছনছ করেছেন। যাকে এক কথায় বলা যায় জঙ্গি শাসন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাক বাকুম করে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন তথা রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একবারও ভাবলেন না, তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে তিনি আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন। ভাবলেন না শপথের কথা। ভাবলেন না তিনি দেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করার শপথ নিয়েছিলেন। জনগণ আশ্চর্য হয়ে দেখল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দোসর হয়ে তাদের রক্তাক্ত হাতের সাথে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করল। যাকে এককথায় বলা যায় বন্দুক ঠেকিয়ে জনগণের প্রতিষ্ঠান দখল।’

‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী তথা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং জামায়াতে ইসলামকে এ দেশে পুনর্বাসন করেন। তাদের রাজনীতি করার অধিকার দেন। তাদের নাগরিকত্ব দেন। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধীদের সংসদ সদস্য করে এবং তাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের সাথে বেইমানি করেন। এরপরও কি বাংলাদেশের জনগণ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারে?’

জিয়া যে মোটেও মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, বরং পাকিস্তানি চর হিসেবে কাজ করেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের সিগনেচার টিউন ‘জয় বাংলা’ উচ্ছেদ করে দেয়। শীর্ষ রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়, অন্যান্য কুখ্যাত রাজাকার যথা কর্নেল মোস্তাফিজ, আলিম, সোলেমান, যাদু মিঞা, শান্তি কমিটির প্রধান বিচারপতি সাত্তার, আব্দুর রহমান বিশ্বাস প্রমুখকে ক্ষমতায় বসায়, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম এবং বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে। সে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণও নিষিদ্ধ করেছিল। জিয়ার ঘনিষ্ঠজন ক্যাপ্টেন নুরুল হক তার বই ‘হাই টাইট হাই টাইম’-এ লিখেছেন, জিয়া পাকিস্তানিদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। একই ধরনের কথা ব্যারিস্টার মওদুদও লিখেছেন। যে ব্যক্তি মুক্তির তিন বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, সে মাত্র তিন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা ছিল তা বিশ্বাস করার কোনোই অবকাশ নেই।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ।। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি