ছবি : সংগৃহীত

ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও রোগী বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর মৌসুম। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আর ব্যাপক গরমও পড়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু বাড়ার আশঙ্কা থাকে।

ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে আসে এডিস মশার মাধ্যমে। বর্ষায় বাসা বাড়িতে পানি জমে এই মশার বংশবিস্তার বেশি ঘটে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরের বছরগুলোয় এর প্রকোপ খুব বেশি না হলেও ২০১৯ সালে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

এতদিন ধারণা ছিল ডেঙ্গু জ্বর শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো এখন ডেঙ্গুর হটস্পট।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘিঞ্জি পরিবেশে অবস্থিত। প্রতিটি ঘরে ৮ থেকে ১০ জন গাদাগাদি করে থাকে। এই কারণে একজনের ডেঙ্গু হলে অন্যদেরও আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে।

পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে মশা জন্মানোর সুযোগ বেশি। অপরদিকে মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা মারার উদ্যোগও কম। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব আছে। মশা নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখে বিশেষত পেছনের দিকে ব্যথা, মাংসপেশি, হাড় এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ইত্যাদি হলো ডেঙ্গুর লক্ষণ। তবে জ্বর, মাথা ব্যথা এবং শরীরে ছোপ ছোপ দাগ—এই তিন উপসর্গ ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ। ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে।

এতদিন ধারণা ছিল ডেঙ্গু জ্বর শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো এখন ডেঙ্গুর হটস্পট।

সাধারণত ৩-১৪ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পায়। কেউ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে লক্ষণসমূহ ভিন্ন রকম হয় এবং তা ৫০০ গুণ বেশি ভয়াবহ ও জটিল আকার ধারণ করে। এটি ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে রূপ নিতে পারে, যা ক্ষেত্র বিশেষে প্রাণঘাতীও হতে পারে। শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি।

ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নেবেন, বাসায় না হাসপাতালে থাকবেন—নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’।

প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট। এই সময় ডেঙ্গু জ্বর বেড়ে যায়।

‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে। কিছু লক্ষণ, যেমন পেটে ব্যথা, বমি, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, অন্তঃসত্ত্বা, জন্মগত সমস্যা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।

‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। এতে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, বাড়িতে কী করবেন? পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। এর কোনো চিকিৎসা নেই। প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন পান করুন একটু পরপর।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?

ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি—সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন—জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এই জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এখন আর মূল বিষয় নয়।

প্লাটিলেটের হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। রক্ত দেওয়ার তো প্রয়োজনই নেই। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে ডাক্তারের পরামর্শে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে।

এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। তবে ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক নেওয়া যেতে পারে। জ্বর চলে গেলে বেশি খেয়াল করতে হবে। আর লক্ষণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। মশারি টানতে হবে, মশা মারতে হবে।

যাত্রার শুরু থেকেই অণুজীবদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে মানবজাতিকে। আমরা লড়াই করে টিকে আছি। আমাদের মাঝে পাঁচটি বড় বড় ভাইরাস এসেছিল, একশ বছর পরপর। এসবের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়েছি। তাই এসব বিষয় নিয়ে আমাদের গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে।

এডিস মশা ঘরে থাকে, জন্মায় বাড়ির ভেতরে জমানো পানির পাত্রে। মাত্র ২ মিলিমিটার পানি পেলেই এই মশা বংশবিস্তার করতে পারে...

পৃথিবীতে সারাবছরই মানুষ কোনো না কোনো ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর আগে কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, করোনাভাইরাস, নিপা ভাইরাসের মতো বিভিন্ন রোগও মহামারি আকারে ছড়িয়েছে।

এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ ডেঙ্গু। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা পৃথিবীর সমস্যা। ৪-৫ দিনের জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেই এডিস মশা জন্ম নিতে পারে। খুবই অল্প পানিতে মশাগুলো ডিম পাড়ে এবং জন্মাতে পারে। যেমন- ডাবের খোসা, বিশেষ করে গাছের টবে জমা পানি, পাত্রে বা বালতিতে রাখা অব্যবহৃত পানি, এসি বা ফ্রিজে জমা পানি ঘরের মধ্যে মশা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া বাড়ির চারদিকে ডাবের খোসা, পলিথিনের ব্যাগ বা অপ্রয়োজনীয় পাত্রে জমে থাকা পানিও এই মশা সৃষ্টির উৎস।

আরও পড়ুন : এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ : করণীয় কী?

গবেষণায় দেখা যায়, এই মশা দেয়ালে না বসে টেবিলে, সোফা, পর্দা ও ঝুলন্ত কাপড়ের নিচে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। তাই এসব জায়গায় অ্যারোসল স্প্রে করতে হবে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূলে রাস্তার স্প্রে-ম্যান ওষুধ স্প্রে করলেই হবে না। কারণ, এডিস মশা নালা, পুকুর, খাল, নদী বা আবর্জনার স্তূপে বংশবিস্তার করে না।

এডিস মশা ঘরে থাকে, জন্মায় বাড়ির ভেতরে জমানো পানির পাত্রে। মাত্র ২ মিলিমিটার পানি পেলেই এই মশা বংশবিস্তার করতে পারে। কাজইে সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা এবং পৌরসভার পাশাপাশি এর সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্তা না বাড়ালে কোনো কিছুতেই সফলতা আসবে না।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োজন হলেও শুধু রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মশা নিধনে লার্ভিসাইডিং ৮০ শতাংশ ও অ্যাডাল্টিসাইডিং ৩০ শতাংশ কার্যকর হলেও লার্ভিসাইডিং বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কারণ এই কার্যক্রমে ক্রয়ের সুযোগ বেশি তৈরি হয়।

আরও পড়ুন : শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

বছরব্যাপী সারা দেশে এখন থেকে এডিস মশা নির্মূলে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির সমন্বিত ক্রাশ পরিকল্পনা নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাইরাস নিয়ে, মশার ডিম ধ্বংসে প্রয়োজনীয় গবেষণা বাড়াতে হবে। তাহলে কোনো ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হলে সেটি নিয়ে কাজ করার মতো দক্ষ জনবল তৈরি হবে। তাছাড়া সাধারণভাবে পাঠ্যপুস্তকে ভাইরাস নিয়ে পাঠ থাকতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে ডেঙ্গু রোগের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা গেলে সবাইকে আরও বেশি আতঙ্কমুক্ত ও সতর্ক করা যাবে।

মোট কথা, ভাইরাস ও ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে ধারণ থাকলেই কিন্তু ভাইরাস প্রতিরোধ করা অনেকটাই সম্ভব হয়ে যাবে। জনগণের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়া ডেঙ্গু বা বিভিন্ন রোগ ও মহামারি—কোনোকিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়া সম্ভব হবে না। সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক। তবে আতঙ্ক নয়, সতর্ক ও সচেতনতাই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারে।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়