ছবি : সংগৃহীত

প্রশাসক, শিক্ষক, লেখক এবং সক্রিয় সমাজ সচেতন ড. আকবর আলি খানের মৃত্যুতে সকলের মতো আমিও মর্মাহত। আমার কাছে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন গবেষণা-নিষ্ঠ উঁচু মাপের লেখক।

বহুমাত্রিক এই প্রতিভা বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার গবেষণালব্ধ বইগুলোর ব্যাপ্তি ছিল জাতীয় বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ, দারিদ্র্যের অর্থনীতি, পরার্থপরতার অর্থনীতি, রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ ছাড়াও আত্মজৈবনিক রচনার মতো বর্ণাঢ্য সব বিষয়।

তিনি হাস্যরসাত্মক গল্প উপাখ্যান ব্যবহার করে বৈঠকি আড্ডার আদলে অর্থনীতির কঠিন সব বিষয় পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন। মোল্লা নাসিরুদ্দিন ছিল তার প্রিয় চরিত্র।

আমার অনুরোধে তিনি ২০০৮ সালে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সমুন্নয়’-এর জন্য বাজেটে জনমানুষের অংশগ্রহণের সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও বাস্তবতা নিয়ে একটি আগ্রহ-উদ্দীপক গবেষণা-নির্ভর বই লিখেছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে আমার ছিল গভীর সম্পর্ক। অসুস্থ শরীরেও শুধু মাত্র মনের জোরে তিনি আমৃত্যু গবেষণা ও শিক্ষকতা করে গেছেন। তার মৃত্যুতে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে যে বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

আরও পড়ুন : দুঃখী মানুষের বাজেটের সন্ধানে 

তখন তাকে আমি নামে জানতাম। সামনাসামনি দেখা হয়নি। প্রথম দেখা হলো ১৯৮০ সালে লন্ডনে। সোয়াসে। তখন আমি পিএইচডির গবেষণা করছিলাম। তিনি তার পিএইচডি শেষ করে কানাডা থেকে দেশে ফিরছিলেন। সামান্য সময়ের দেখা। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত মৃদুভাষী ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আজীবনের সম্পর্কের সূত্রপাত হলো সেদিনই।

এরপর গবেষণা শেষ করে দেশে ফিরে তার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীরতর হয়েছে। সেই সম্পর্কের গভীরতা শেষ পর্যন্ত একই পর্যায়ে ছিল। কত কথা। কত স্মৃতি তাকে ঘিরে।

তখন তিনি অর্থ সচিব। মন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত শাহ এস এম কিবরিয়া। আমি তখন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসি। ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের জন্য তাদের উভয়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পেয়েছি।

তিনি হাস্যরসাত্মক গল্প উপাখ্যান ব্যবহার করে বৈঠকি আড্ডার আদলে অর্থনীতির কঠিন সব বিষয় পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন। মোল্লা নাসিরুদ্দিন ছিল তার প্রিয় চরিত্র।

একদিন সচিবালয়ে ড. খানের অফিসে গিয়েছি। হঠাৎ একটি টেলিফোন এলো। মনে হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর টেলিফোন। তিনি বারে বারে ‘স্যার’ বলছিলেন টেলিফোনে। কোনো একটি প্রকল্পের জন্য হয়তো অর্থ ছাড় নিয়ে কথা বলছিলেন। খুবই সৌজন্যের সাথে তিনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে ঐ প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের কোনো সুযোগ নেই। কেননা এটি একনেকে পাসই হয়নি। ওপার থেকে মনে হলো অর্থ সচিবের যুক্তি মেনেই নিলেন।

যখন মন্ত্রী জোর করছিলেন তখন ড. খান হেসে হেসে বলছিলেন, প্রকল্প পাস করা হলে তিনি কেন অর্থ ছাড় করবেন না? তিনি তো চেকবই পকেটে নিয়েই বসে আছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সরকারি কর্মকর্তার এমন কথোপকথনে আমি খুবই স্বস্তিবোধ করছিলাম এই জন্য যে, উভয়েই তাদের দায়িত্বের সীমানার মধ্যে থেকেই কাজ করছিলেন। কেউ সীমা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেননি।

প্রশাসক হিসেবে কতটা সফল ও সুবিবেচক—সেই আলাপে নাইবা গেলাম। তিনি বেঁচে থাকবেন তার অসাধারণ লেখনির জন্য। বহুমাত্রিক এই জীবন-ঘেঁষা লেখক নিজস্ব এক স্টাইল তৈরি করেছেন। প্রতিটি বই লেখার আগে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন।

আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের 

এমন নিষ্ঠাবান ক’জন লেখকই বা আছেন আমাদের সমাজে? আর তার লেখার বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্য দেখে অবাক হতেই হয়। তার রচনা সম্ভার এতই বিচিত্র এবং গভীর যে, এসবের পর্যালোচনা করার মতো জায়গা এটি নয়। তবুও আজ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তার লেখা কয়েকটি বইয়ের আংশিক পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি এই লেখায়।

শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনমানুষের অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বই লিখে গেছেন আমাদের জন্য। এর মধ্যে আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই—‘বাংলাদেশের বাজেট প্রক্রিয়ায় গণমানুষের অংশীদারিত্ব: কতিপয় নীতিমালা সংস্কার’ শিরোনামের বইটির কথা।

আমার অনুরোধে শরীর খারাপ থাকার পরও ড. খান এই বইটি লিখেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সমুন্নয়’ থেকে। এই বইতেই তিনি লিখেছেন, “আধুনিক যুগেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিরাট কাঠামো। এখানে জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ... আপাতদৃষ্টে সবাই কাজ করছে, কিন্তু যে পরিমাণ কাজ করছে, তাতে জনগণের চাহিদা মিটছে না। ... এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে গণজাগরণের প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণ তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সক্রিয় হবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু অর্জন করা যাবে না। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে।”

এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বলেই মানুষকে নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ড. আকবর আলি খান লেখালেখি করে গেছেন।

একদিন সচিবালয়ে ড. খানের অফিসে গিয়েছি। হঠাৎ একটি টেলিফোন এলো। মনে হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর টেলিফোন। তিনি বারে বারে ‘স্যার’ বলছিলেন টেলিফোনে। কোনো একটি প্রকল্পের জন্য হয়তো অর্থ ছাড় নিয়ে কথা বলছিলেন....

স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচন ও দারিদ্র্য ভাবনা ড. আকবর আলি খানের লেখালেখির বিষয় হয়েছে। তা নিয়ে যে বইটি সর্বশেষ পড়েছি সেটি হলো, ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ (প্রথমা, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০২২)।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন তিনি। সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকালেও বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর নিজের আগ্রহের জায়গা থেকে এই বিষয়ে করেছেন গভীর গবেষণা। সবকিছুর সম্মিলনে এই বইতে আমরা দারিদ্রের রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি সহজবোধ্য বর্ণনা পেয়েছি।

একইসঙ্গে এই বইতে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে একরৈখিক সংখ্যাবাচক ভাবনাগুলোর সীমাবদ্ধতাগুলোও তিনি তুলে ধরেছেন। তাই লিখেছেন, “একথা স্বীকার করতেই হবে, দারিদ্র্যের হার ও সংখ্যা সম্পর্কে যেসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, তা বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস হয়েছে, এই ধারণা সমর্থন করে। কিন্তু সব সংখ্যা সম্পর্কেই সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। ... এখনো দরিদ্রদের সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছুই জানি না। তাই দারিদ্র্য সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া সংখ্যাতত্ত্ব ও অর্থনীতির বাইরে যেসব শাস্ত্রে দরিদ্রদের নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে (যেমন নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি) সেইসব গবেষণার ফলাফলও দারিদ্র্য নিরসনের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”

আরও পড়ুন : রূপসী বাংলার ক্ষত ও জীবনানন্দ দাশ 

আজকে সারা বিশ্বেই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ’-এর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ উন্নয়ন গবেষকরাও ড. খানের লেখা এই বইটি থেকে দারিদ্র্য বিষয়ক ভাবনা ও গবেষণার যথেষ্ট রসদ পাবেন আগামী দিনগুলোতে।

ড. আকবর আলী খান নিজেও একজন মাল্টিডিসিপ্লিনারি প্রতিভা ছিলেন। অর্থনীতি ও উন্নয়ন নীতি-কৌশলের বিষয়গুলো নান্দনিক মাত্রা দিয়ে সহজভাবে সবার কাছে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে সাহিত্যও তার চিন্তা-চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গাতেই থেকেছে সবসময়। এক্ষেত্রেও সাহিত্যের যে মূলভাবগুলো আমাদের জীবনচলার জন্য নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে সেগুলো বারবার সামনে আনতে চেয়েছেন নিজের লেখালেখির মাধ্যমে।

তাই ‘চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন’ বইতে তিনি জীবনানন্দের কাজগুলোর গভীরতর পাঠের প্রয়োজনীয়তার এবং সমকালে সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতার ওপর আলোকপাত করেছেন।

তিনি লিখেছেন, “জীবনানন্দের সৃষ্টি এখনো অনাবিষ্কৃত মহাদেশের মতো। নতুন করে তাকে আবিষ্কারের প্রয়োজন রয়েছে।” আমাদের পাঠকদের অধিকাংশই জীবনানন্দের কবিতার ‘চাবিকাঠি খুঁজে পাননি’ বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, “... জীবনানন্দের কবিতা নিছক উপমার সংকলন নয়, এইসব কবিতায় দর্শন সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত হয়েছে।”

ড. আকবর আলী খান নিজেও একজন মাল্টিডিসিপ্লিনারি প্রতিভা ছিলেন। অর্থনীতি ও উন্নয়ন নীতি-কৌশলের বিষয়গুলো নান্দনিক মাত্রা দিয়ে সহজভাবে সবার কাছে তুলে ধরেছেন...

এই বইতেই একজন প্রকৃত দার্শনিকের মতো তিনি লিখে গেছেন, “... পৃথিবীতে শতভাগ লোক মুনাফেক নয়, আবার শতভাগ লোক সৎও নয়। সততা ও মুনাফেকির আলপনায় চলছে মানুষের জীবন।”

মানুষের যাপিত জীবন ও কর্ম নিয়ে তার এমন গভীর দর্শনের আরেকটি প্রতিফলন ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’ (প্রথমা, জানুয়ারি, ২০১৯) শিরোনামের বই। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথকে যেসব প্রশ্নে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেসব প্রশ্নের বেশিরভাগই অসার।

অন্যদিকে যেসব প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথকে অতি উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেসব প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের যেসব দুর্বলতা ছিল, সেগুলো চাপা দেওয়া হয়েছে। দোষে গুণে মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এর বাইরে নন।

আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য

রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার শেষ কথা, ‘রবীন্দ্রনাথ সমাজ পরিবর্তন চান—আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নয়, মানুষের জন্য। ... তিনি জানতেন, যেকোনো টেকসই সংস্কার বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সব সংস্কার কর্মকাণ্ডে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সংস্কার রক্ষা করার শক্তি তারা নিজেদের ভেতর থেকেই সংগ্রহ করতে পারে।”

এভাবেই একই সঙ্গে গভীর এবং নির্মোহ মূল্যায়ন ও বর্ণনা ড. আকবর আলি খানের লেখালেখিকে দিয়েছে একটি অনন্য মর্যাদা। আমাদের চিন্তা ও চর্চার জগতে তার এসব কাজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও বহুকাল।

ড. আকবর আলি খানের শূন্যতা যে পূরণ হওয়ার নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু আমাদের প্রত্যাশা আমাদের আগামী প্রজন্ম ড. খানের লেখালেখি ও পেশাজীবনের ত্যাগ, ধৈর্য ও অর্জনগুলো থেকে শিক্ষা নেবে।

এমন ব্যক্তিত্বের জীবন যদি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে তবেই আমরা দেশকে নিয়ে যে বড় স্বপ্নগুলো দেখছি সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন তার অমর সৃষ্টিশীল লেখালেখির জন্য।

ড. আতিউর রহমান ।। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর