ছবি : সংগৃহীত

জীবনের সব কাজ সাফল্যের সাথে শেষ করে হাসিমুখে, তৃপ্তি নিয়ে অন্তহীন পথে পাড়ি দিলেন বাংলা গানের কালজয়ী অগ্রজ গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এক বর্ণাঢ্য, সফল জীবন ছিল তার। কর্মমুখর, অনন্য এবং অতুলনীয়। এমন জীবনযাপন করা মানুষকে আমি দেখতে চেয়েছি অন্য দৃষ্টি দিয়ে।

গাজী ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় অনেক দেরিতে। তার বাসা আর আমার বাসা বারিধারা পার্ক রোডে, প্রায় পাশাপাশি। ৭০ এবং ৮২, এই শুধু তফাৎ। হাঁটাহাঁটি বা মসজিদের যাওয়ার সময় মাঝে মধ্যেই দেখা হতো। দেখা হলেই বলতেন, ‘তুমি সম্ভবত দ্বিতীয় গীতিকবি যে এই এলাকায় থাকো।’ আমি তাকে শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলতাম, ‘আমার সৌভাগ্য যে আমি আপনার প্রতিবেশী।’

গাজী ভাইয়ের ছোট ভাই পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান লিরিক গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার লিটন ভাই। গাজী ভাই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ২০১০ সালে লিটন ভাইয়ের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়, ‘প্রিমিয়ার ব্যাংক গর্ব’ নামে পোশাক শিল্পের কর্মীদের নিয়ে একটা গানের অনুষ্ঠান তৈরির সময়। কী উদার এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন গাজী ভাই, তার অসংখ্য গল্প শুনেছি লিটন ভাইয়ের কাছে। তার সাথে আলাপে বোঝাই যেত গাজী ভাইয়ের সান্নিধ্য তাকে কতটা ঋদ্ধ করতো।

আরও পড়ুন : আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে 

দুই ভাইয়ের শ্রদ্ধার সম্পর্ক আর এখনো এক পরিবার হয়ে ব্যবসা করা এগুলো এই সময়ে খুবই বিরল এবং অনুকরণীয়। গাজী ভাই পরিবারের প্রাণশক্তি হয়ে পারিবারিক মূল্যবোধ যে অটুট রেখেছিলেন সেটা অবলীলায় বলতেন লিটন ভাই।

দুই ছেলেমেয়ে উপল এবং দিঠিকে দূর থেকে দেখেছি তারাও বাবা অন্তঃপ্রাণ। মানুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, পুরোটাই হয়তো বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাবা হিসেবে প্রত্যেকেই সন্তানের কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আশা করতেই পারি।

গীতিকবি সংঘ নিয়ে তার কিছুটা সংশয়ও ছিল। প্রায়শই বলতেন, ‘গানের মানুষেরা এক হতে জানে না। তোমরা পারবে তো?’

করোনার সময় আমরা ‘গীতিকবি সংঘ’ সংগঠিত করি। সেই সময় গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, কবির বকুল, জুলফিকার রাসেল এবং আমি গাজী ভাইয়ের আরও কাছাকাছি আসি। তিনি দীর্ঘক্ষণ অনলাইনে আর সামনাসামনি সাক্ষাতে বসে আমাদের দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিতেন।

গানের কপিরাইট, আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিসহ কীভাবে আগাতে হবে সেই বিষয়ে তার ভাবনা ছিল সুস্পষ্ট। বলেছিলেন, ‘তোমরা কোনো চিন্তা করো না, প্রয়োজনে আমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাব। গীতিকবিদের সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত করতে তোমরা ঐক্যবদ্ধ হও। অগ্রজদের সামনে রেখে এগিয়ে যাও।’

গীতিকবি সংঘ নিয়ে তার কিছুটা সংশয়ও ছিল। প্রায়শই বলতেন, ‘গানের মানুষেরা এক হতে জানে না। তোমরা পারবে তো?’ আমাদের দুই বছরের কার্যক্রম নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন গীতিকবি সংঘের সম্মানিত আজীবন সদস্য।

আরও পড়ুন : আজম খান : আসি আসি বলে তুমি আর এলে না 

শিল্পকলা একাডেমিতে প্রয়াত কিংবদন্তী সুরকার আলম ভাইয়ের (আলম খান) স্মরণ সভা। গাজী ভাই আসলেন। তাকে জানালাম গীতিকবি সংঘ নির্বাচনে যাচ্ছে। শুনে তিনি অবাক হলেও আনন্দ এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। পরে সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়েছে জেনে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন।

আলম ভাইয়ের স্মরণ সভায় অদ্ভুত আবেগে কিছু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আলম ভাইয়ের ভেতর অভিমান বাসা বেঁধেছিল, নয়তো ‘হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস!’ সুর করতে পারতেন না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।

ঐ অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গাজী ভাই ষাটের দশকের শেষভাগ আর সত্তরের দশক জুড়ে তার কর্মব্যস্ততার কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একজন লেখক হিসেবে কলম তুলে নেওয়াটা ছিল তার নৈতিক দায়িত্ব। তার জীবনের বড় একটা অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। তার মুক্তিযুদ্ধ ও দেশাত্মবোধক অমর গীতিকবিতাগুলো কালোত্তীর্ণই শুধু নয়, কালজয়ীও বটে। এমন অবদান বাংলা সাহিত্যে খুব কম গীতিকবিরই রয়েছে।

গাজী ভাই বলতেন, তিনি বিশ্বাস করেন শিল্পী মরে না। শিল্পী রেখে যান স্মৃতিময় স্মৃতি যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উৎসাহব্যঞ্জকও হতে পারে, দুঃখের কারণও হতে পারে। এই সৃষ্টি স্পর্শ করে মানুষের অনুভূতি আর শিল্পী বেঁচে থাকেন হৃদয় থেকে হৃদয়ে। শিল্পীর জীবন থেমে যায় শিল্প বেঁচে থাকে।

আরও পড়ুন : ফকির আলমগীর: গণসংগীত যার সম্বল 

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে গাজী ভাইয়ের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হয় ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২। সেখানে কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ আর আমি ছিলাম একসাথে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “আমরা যারা সংগীতের সাথে জীবনকে জড়িয়েছি তাদের অনেক সৃষ্টিই কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠে বা উঠবে সময়ের পরিক্রমায়। কিন্তু এর মাঝে একটা বিশেষ কিছু সৃষ্টি থাকে, যা একজন মানুষকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গাজী ভাইয়ের এমনই একটি গান। এরকম একটি গান একজন গীতিকবিকে অমর করে দেওয়ার জন্য জন্য যথেষ্ট।”

দেশপ্রেম, বিরহ, প্রেম, ভালোবাসা, রম্য, দ্রোহ, সম্পর্ক তার গীতিকবিতায় বিচরণ করতো অবলীলায়। গীতিকবিতা নিয়ে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার ক্ষমতা গাজী ভাইয়ের ছিল সহজাত।

গাজী ভাইকে নিয়ে শিল্পী রবি চৌধুরীর সাথে আলাপচারিতার সময় বলেন, ‘তিনি খুব অল্প সময়ে গীতিকবিতা রচনা করতেন।’ জানালেন, তার ‘এক নয়ন’ নামের অ্যালবামের শিরোনাম গানের গীতিকবিতা রচনার কথা। গাজী ভাই তখন মালিবাগ থাকতেন। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে তিনি বাসায় বসে গান লিখে দিয়েছিলেন—

‘দৃষ্টি হারা দুই নয়নকে লোকে বলে অন্ধ
ভালোবাসার ব্যথা পাবে এক নয়নে কান্দো
সেই নয়নের নামটি হলো মানুষের অন্তর
সেখানেতে বসত করে প্রেমের কারিগর’

আমার স্কুল বন্ধু ফরিদ। ফরিদ আহমেদ, সিলেট প্রবাসী। তার সাথে গাজী ভাইয়ের পারিবারিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কের শুরু ষাট বছর আগে, পারিবারিকভাবে, যখন ফরিদের জন্ম হয়নি। ফরিদের বাবা তখন দেবীদ্বারের সরকারি পোল্ট্রি ফার্মের প্রধান। গাজী ভাই তখন মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়েন।

আরও পড়ুন : সঞ্জীব চৌধুরী : শহরের নাম না জানা এক মাস্তান 

ফরিদ জানাল, সেই থেকে আজ পর্যন্ত ফরিদ বা ফরিদের পরিবারের কেউ ঢাকায় আসলে গাজী ভাইয়ের বাসা ছাড়া অন্য কোথাও উঠতে পারেননি। তিনি দেননি। ভালোবাসা, মায়া আর শাসন দিয়ে তিনি ঢেকে রেখেছিলেন তার চারপাশ।

বাংলা ভাষাভাষী গীতিকবিদের মাঝে এত বৈচিত্র্যময় গীতিকবিতা রচনার নজির আমার চোখে পড়ে না। দেশপ্রেম, বিরহ, প্রেম, ভালোবাসা, রম্য, দ্রোহ, সম্পর্ক তার গীতিকবিতায় বিচরণ করতো অবলীলায়। গীতিকবিতা নিয়ে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার ক্ষমতা তার ছিল সহজাত। এমন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষ বিরল।

সব সরকারের আমলেই তিনি সম্মানিত হয়েছেন। আমাদের আশা শিল্পীদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা সত্ত্বেও সত্যিকারের শিল্পীর মর্যাদা ও সুযোগ দেওয়ার রীতিটা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হোক। বাঙালি ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিনই গাজী ভাইয়ের গান মানুষের হৃদয়, মানুষের অনুভূতি ছুঁয়ে যাবে।

আসিফ ইকবাল ।। গীতিকবি