ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় দেখতাম—গ্রামে প্রতি পাড়ায় অন্তত এক বাড়িতে বট পাতার বিড়ি বিক্রি হতো। হাটবাজারের দূরত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে বিড়ি বিক্রির এই ঘরোয়া বাজার কিন্তু খারাপ চলতো না। তাছাড়া আরেকটা কারণ ছিল, এই বট পাতার বিড়ির কাস্টমারের একটা বড় অংশ ছিল মহিলা, যারা ধূমপান করতেন গোপনে, খুবই গোপনে।

কিন্তু কেন নারীরা গোপনে ধূমপান করতেন তার কোনো ডকুমেন্ট না থাকলেও অনুমান করা যায় যে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর ধূমপান খারাপ ভাবে নেওয়া হতো। তাই নারীকে গোপনে ধূমপান করতে হতো।

সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত রয়েছে। ধূমপান যদি খারাপ হয়—তা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই খারাপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নারী পুরুষ যদি এক সাথে ফুচকা খেতে পারেন, রিকশায় পাশাপাশি বসে যদি নারী পুরুষ কাসুন্দি পেয়ারা ভাগাভাগি করে খেতে পারেন—তাহলে নারী পুরুষ একটা সিগারেট ভাগাভাগি করে খেলে দোষের কী ঘটল, তা আমার জানা নেই।

প্রেমিক যদি পার্কের বেঞ্চিতে বসে মুখ ভর্তি ধোঁয়া প্রেমিকার মুখের উপর ছেড়ে দিতে পারে, তাহলে প্রেমিকার ধূমপানের অসুবিধা কোথায়—সেটা আমার বোধগম্য নয়। যদিও ধূমপানের ক্ষেত্রে শুধু নারীর বেলায় সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি তা নয়, এটা যেন দুর্বলের উপর সবলেরও দৃষ্টিভঙ্গি, ছোট'র উপর বড়'র খবরদারি। সেজন্য আমরা দেখতাম—বাবা পুত্র দুইজনই ধূমপায়ী, কিন্তু বাবা প্রকাশ্য—ছেলে গোপনে, শিক্ষক প্রকাশ্যে—ছাত্র গোপনে, নেতা প্রকাশ্যে—কর্মী গোপনে! সমাজপতিদের এমন খবরদারির দৌরাত্ম্য ভেঙে যাক সেটা বিবেকবান যেকোনো ব্যক্তিরই কামনা করা উচিত। কিন্তু কীভাবে?

আরও পড়ুন : আইন মানুষের জন্য নাকি আইনের জন্য মানুষ? 

সেজন্য কী ছেলেও বাবার সামনে বা এক সাথে ধূমপানে লেগে যাবে? ছাত্র শিক্ষক ভাগাভাগি করে ধূমপান করবে? প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনে মিলে কক্সবাজারে এক ডাব খাওয়ার স্টাইলে এক বিড়িতে আয়েশ নেবে? সেটা ভেবে দেখা যাক। তার আগে ধূমপানের কিছু তথ্য জেনে নিই।

বিশ্বের যে দশটি দেশে সবচেয়ে বেশি ধূমপায়ী বাস করেন তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এছাড়া ২৫ বছরে বাংলাদেশে পুরুষ ধূমপায়ীর শতকরা হারে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তবে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট'-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। কয়েকশ বিজ্ঞানীর তথ্য দিয়ে ‘গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজেস' শীর্ষক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

নারী ধূমপায়ীদের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ২২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ধূমপায়ীদের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ক্রোয়েশিয়া।

অধিক ধূমপায়ী ২২টি দেশকে নিয়ে করা ক্রোয়েশিয়া উইক এর সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন। ক্রোয়েশিয়া উইক আরও প্রকাশ করে যে, পশ্চিমা দেশগুলোয় ধূমপানের ওপর কড়াকড়ি বাড়ার কারণে তামাকজাত পণ্য প্রস্তুত কোম্পানিগুলো ভারত ও চীনের ভোক্তাদের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

একদল গবেষক ১৯৮০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৭টি দেশে ধূমপায়ীদের ওপর নজর রেখেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জেএএমএ) নামের একটি স্বাস্থ্য সাময়িকীর খবরে বলা হয়, ভারতে ৩০ বছরে পুরুষ ধূমপায়ীর হার ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে নারী ধূমপায়ীদের হার দুই শতাংশ বেড়েছে।

আরও পড়ুন : তামাক কেন ক্ষতিকারক? 

বিশ্বব্যাপী শতকরা হিসেবে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমলেও ধূমপানের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি। রিপোর্টে বলা হয়, সারা বিশ্বে ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী ধূমপান। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যকই চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়ার নাগরিক।

এই চারটি দেশের ধূমপায়ী সংখ্যার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, জাপান, ব্রাজিল আর জার্মানির ধূমপায়ীর সংখ্যা যোগ করলে, তা বিশ্বের মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার প্রায় সাড়ে ৬৩ শতাংশ হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

ধূমপান নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ধূমপানে উপকার হয় এমন একটা  উদাহরণ যদি কেউ দিতে পারেন, তবে তাকে আমি ধূমপান ছাড়তে বলব না।’ সত্যিই একটা আশ্চর্যের  ব্যাপার হচ্ছে 'ধূমপান'-এ কোনোই উপকার নেই এবং অসংখ্য ক্ষতি জেনেও মানুষ ধূমপান করেন।

দ্রুত উন্নয়নগামী দেশগুলোর মধ্যে যারা টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেসব দেশের যুব সমাজকে প্রস্তুত করছে রাষ্ট্র। তার মধ্যে ধূমপান প্রবণতা ও একটি ইস্যু তাদের কাছে। কারণ ধূমপায়ীরা শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনকারী।

চীনে যারা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে, তাদের প্রত্যেককে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষাৎকার নিতে হয়। সেজন্য প্রায়ই একাডেমিক ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যখনই কেউ প্রশ্ন করেছে, চীনের কী তোমার অপছন্দ হয়েছে?

বলেছি, দুয়েকটা বিষয় ছাড়া সত্যিই আমি চীনা সংস্কৃতির প্রশংসা করতে চাই। সেই দুয়েকটার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চীনারা অধিক মাত্রায় ধূমপায়ী এবং প্রকাশ্যে/লোকালয়ে ধূমপান করে।

বিশেষ করে প্রত্যেক আবাসিক ভবনের নিচে বয়স্কদের বসার জন্য যে সোফা দেওয়া আছে, সেখানে বসে চীনা বয়স্ক নারী পুরুষ এক সাথে এমন ভাবে ধূমপান করেন যেন মশা তাড়ানোর জন্য সবাই কয়েল জ্বালিয়ে রেখেছেন।

আমার এমন মন্তব্য শুনে একজন মুচকি হাসি দিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, 'তুমি কী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রছাত্রীদের এভাবে ধূমপান করতে দেখেছ?' একটু চিন্তা করে জবাব দিলাম, মনে পড়ছে না।

তারা বলে, 'শুনো, আমাদের ইয়ং জেনারেশন বুঝতে পেরেছে ধূমপানের অপকারিতা, তাই আমরা ধূমপান করি না। তবে ওল্ড জেনারেশনকে আর আমরা বাঁধাও দিতে চাই না। দে ক্যান ইনজয় দ্যায়ার লাইফ উইথ স্মোকিং' বলে হেঁসে দিল সাক্ষাৎকার গ্রহীতা।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা, দায়দায়িত্ব কার?

বিষয়টি একটু ভাবিয়ে তুললো আমাকে। ফলো করতে লাগলাম ইয়ং জেনারেশন। সত্যিই লক্ষ্য করলাম, তাদের যুব সমাজ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ধূমপান করা তেমন চোখেই পড়েনি!

এই অবস্থার পুরো বিপরীত চিত্র আমাদের দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে নাকি সিগারেট না ধরতে পারলে সে গেঁও। এমন আধুনিকতায় পিছিয়ে নেই মেয়েরাও। এখন মেয়েরাও প্রকাশ্যে ধূমপানে নেমে পড়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকার রাস্তায় এটা এখন খুবই স্বাভাবিক।

প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মেয়েরা এদিকে একটু বেশি এগিয়ে আছে। সম্প্রতি একটি জরিপে এসেছে যে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ৭২ শতাংশ মেয়েই ধূমপান করে। যদি কেউ অধূমপায়ী হয়, সে সেকেলে। তাই অন্তত আধুনিক হওয়ার জন্য হলেও ধূমপান করে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের সামনে সিগারেটে টান দিলে সে খুবই মডার্ন। নারীর সম-অধিকারেও হয়তো এটা মাত্রা বাড়িয়েছে।

ছাত্র বয়সে দেখতাম সহপাঠীদের মধ্যে কেউ ধূমপান করলে মেয়ে সহপাঠীদের সামনে তা বেরও করতো না, কারণ তারা বাঁধা দেবে বা বন্ধুত্বে দূরত্ব সৃষ্টি হবে। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। 'পুরুষের হাত থেকে সিগারেট কেঁড়ে ফেলে দেওয়ার চেয়ে দু'জন ভাগাভাগি করে খাওয়াই হয়তো উত্তম' এমন একটা সাম্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নারীর সম অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ভ্যানিটি ব্যাগ হতে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটার চাই ছাত্রের কাছে। প্রেমিককে ধূমপান ছাড়ার হুমকি না দিয়ে বা তার মুখ ভর্তি ধোঁয়া আকাশে ছুঁড়লে তার মধ্যে স্বস্তির নিশ্বাস না খুঁজে-নিজেকেও 'মডার্ন বানানোর ধোঁয়ায়' নিকোটিনে পুড়াতে বসেছে কপাল পোড়া তরুণীরা। আধুনিকতার কাল্পনিক নেশায় অন্যকে খারাপ কাজে বাঁধা না দিয়ে নিজেও একাকার হওয়ার এমন সিদ্ধান্ত সমাজের জন্য অশনিসংকেত।

অন্যায়কে প্রতিহত না করে, নিজেকে অন্যায়ে ডুবিয়ে অধিকারের সাম্যতা বাস্তবায়ন করা বোকার কাজ—যা অপ্রত্যাশিত।

ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান ।। বিসিএস, সাধারণ শিক্ষা; পিএইচডি, হুয়াজং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চীন