ছবি : সংগৃহীত

১ অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবস। ১৯৪৯ সালের এই দিনে, বেইজিংয়ের থিয়ানআনমেন মহাচত্বর থেকে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান মাও সে তুং। সেদিন পৃথিবীর বুকে পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় নয়াচীন; অবসান ঘটে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন চীনে শত বছরের বিদেশি আগ্রাসন ও অপশাসনের।

জাপানি আগ্রাসন-বিরোধী লড়াই ও পরবর্তীকালের গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত নয়াচীনকে পুনরায় গোড়া থেকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না মোটেই। অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে চীনকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে হয়েছে।

শুরুতে নয়াচীনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কোটি কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা; তাদের অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যের ভিত্তিতেই চীন সামনে এগিয়েছে এবং মাত্র সাত দশকে অর্জন করেছে বিপুল সাফল্য।

সাত দশকে চীনে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে; পরিবর্তন ঘটেছে বলতে গেলে সব ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে চীন অর্জন করেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। সবাই জানেন, প্রাচীন চীন বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালের নয়াচীন ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্বল, গরিব ও পশ্চাৎপদ কৃষিভিত্তিক দেশ। সেই অবস্থা থেকে দেশটির বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়াকে ‘অলৌকিক ঘটনা’ বলা বোধ করি অতিরঞ্জন নয়। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে সঠিক নেতৃত্ব ও চীনা জনগণের কঠোর পরিশ্রমের ফলে।

আরও পড়ুন : চীনের শারদীয় বিষুব 

১৯৪৯ সালের পর চীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় মোটাদাগে দুটি পর্যায় অতিক্রম করে। প্রথম পর্যায়টি ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর, দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে এবং সেই পর্যায় এখনো চলছে। প্রথম পর্যায়ে, মানে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত, চীন পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে উন্নয়নের চেষ্টা চালায়। তখন চীনের লক্ষ্য ছিল শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা।

কিন্তু সেই পথে চীনের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। এরই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে, তত্কালীন চীনা নেতা তেং সিয়াও পিং, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি গ্রহণ করেন। তখন থেকেই চীন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করতে শুরু করে এবং বিশ্বের সামনে ধীরে ধীরে নিজেকে উন্মুক্ত করতে থাকে।

সমাজতান্ত্রিক দেশে বাজার অর্থনীতির কার্যকারিতা নিয়ে তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, এই নতুন এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হবে এবং চীন মহাসঙ্কটে পড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটাই। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চীনকে বদলে দিয়েছে আমূল। চীন নতুন এক্সপেরিমেন্টে, নতুন ব্যবস্থায় যে অগ্রগতি অর্জন করে, তা ইতিহাসে বিরল।

১৯৭৮ সালের পর, প্রায় তিন দশক ধরে, চীনের অর্থনীতি বছরে গড়ে ১০ শতাংশ করে বেড়েছে। এর ফলে চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগেই চীনের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ হতদরিদ্রমুক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে মোটাদাগে হতদরিদ্রমুক্ত করা। অথচ চীন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ, নিজেকে হতদরিদ্রমুক্ত করতে ১০ বছর কম সময় নিয়েছে!

শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেই চীন বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে, তা নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতেও এখন চীন অনেকদূর এগিয়েছে; এগিয়েছে সামাজিক উন্নয়নের পথেও। চীনের শিক্ষা-ব্যবস্থা, চিকিৎসা-ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থা পৌঁছে গেছে বিশ্বমানে।

আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?

সমাজের প্রায় শতভাগ মানুষ এসেছে চিকিত্সা বীমার আওতায়। গোটা চীন জুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ঘটেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। দ্রুতগতির রেলের মতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও চীনের কাছাকাছি নেই।

বর্তমানে চীন নতুন একটি পর্যায় অতিক্রম করছে। এখন দেশটি দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে, উচ্চমানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে।

সরকার এখন আর আগের মতো স্রেফ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামায় না। ২০২০ সালে, মহামারির প্রেক্ষাপটে, প্রথমবারের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য স্থির না করে সেটা প্রমাণ করে সরকার। চীন এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকা শক্তির সন্ধানেও আছে।

নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর শুরুতে এই দেশে স্বাভাবিকভাবেই পরিকল্পিত অর্থনীতি ছিল। সেই পর্যায়ে চীন মূলত উন্নয়নের সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে। তখন চীনের লক্ষ্য ছিল ভারী শিল্প গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। এই মডেল একটি উন্নয়নশীল দেশকে দ্রুত আধুনিক শিল্প-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে সক্ষম হলেও, এর অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে। চীনও এই মডেল অনুসরণ করে তুলনামূলকভাবে সম্পূর্ণ আধুনিক শিল্প-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিল।

কিন্তু সেই ব্যবস্থা চীনের তুলনামূলকভাবে নিম্ন মাথাপিছু আয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। ১৯৪৯ সালে নয়াচীন প্রতিষ্ঠার সময়, শহর ও গ্রামের দ্বৈত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে, গ্রামাঞ্চলের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল। এর কয়েক বছর পর, ১৯৫২ সালে, চীনের মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ১১৯ ইউয়ান (বর্তমান বিনিময় হার ধরলেও মাত্র ১৭ মার্কিন ডলার)। অর্থনীতির সোভিয়েত মডেল জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়াতে পারেনি। ফলে, তাদের জীবনমান অনুন্নতই থেকে যায়।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীন পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথে পা রাখে। সেই সময় বিশ্বে নিওলিবারেল ডেভেলপমেন্ট থিওরি প্রচলিত ছিল। কিন্তু চীনের নেতৃবৃন্দ সেই থিওরি গ্রহণ করেননি।

আরও পড়ুন : মেট্রোরেল যেন সুপার শপ না হয় 

তারা দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতির আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলা হয় এবং সেসব অঞ্চলের প্রাধান্য কাজে লাগানো শুরু হয়। পাশাপাশি, ব্যবসা-পরিবেশ উন্নয়নের দিকেও নজর দেয় সরকার।

বিংশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকেও বিশ্বে নিওলিবারেলিজম বহাল তবিয়তে ছিল। নিওলিবারেল অর্থনীতিবিদরা ‘শক থেরাপি’র পক্ষে ছিলেন। তাদের মতে, একমাত্র এই থেরাপির মাধ্যমেই একটি পরিকল্পিত অর্থনীতিকে বাজার-অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।

তাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন যে, চীনের গৃহীত বিশেষ অর্থনৈতিক-পদ্ধতি, যাতে সরকার ও বাজার—উভয়ের ভূমিকা আছে, দেশের জন্য আরও বেশি সমস্যা ডেকে আনবে। কিন্তু, তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

চীন চার দশক ধরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে গেছে। এক্ষেত্রে চীন যা অর্জন করেছে, তা অর্জন করতে উন্নত দেশগুলোর লেগেছে শত শত বছর। চীনের এই অর্জন ছিল অভূতপূর্ব, বিশ্ব-কাঁপানো। গোটা সময়কাল ধরে চীন সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ গভীর থেকে গভীরতর করার নীতিও অনুসরণ করে গেছে। 

এরই ধারাবাহিকতায়, ২০১৩ সালে অষ্টাদশ সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ সভায় সংস্কার-প্রক্রিয়া সার্বিকভাবে গভীরতর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বাজারের ভূমিকা বাড়ানো এবং সরকারের ভূমিকা উন্নত করার কথা বলা হয়।

ঊনবিংশ সিপিসি জাতীয় কংগ্রেসের রিপোর্টেও জোর দিয়ে বলা হয় যে, সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বাজারকে নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে এবং সরকারের ভূমিকাও উন্নত করতে হবে।

বর্তমানে চীন তথা বিশ্ব ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের সামনে উন্নয়নের সুযোগ যেমন এন্তার, তেমনি চ্যালেঞ্জও অনেক। চীনের অর্থনীতি বর্তমানে ‘নিউ নর্মাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থায় প্রবেশ করেছে। এই অবস্থায় ‘কার্যকর বাজার’ ও ‘দায়িত্বশীল সরকার’-কে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এই কথা সত্য যে, মহামারি, ইউক্রেন সংকট, বৈশ্বিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে, অন্যান্য দেশের মতো, চীনের অর্থনীতিও বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই দেশটি এগিয়ে চলেছে। ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যম মানের সচ্ছল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছে চীন। এখন সমাজতান্ত্রিক আধুনিক সচ্ছল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে এর সরকার ও জনগণ। এই লক্ষ্যও শেষ পর্যন্ত অর্জিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন। এমন বিশ্লেষকের মধ্যে যেমন চীনারা আছেন, তেমনি আছেন বিদেশিরাও।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে মেট্রোরেল : সম্ভাবনা ও কিছু ভাবনা 

প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো কি উন্নয়নের চীনা মডেল অনুসরণ করতে পারে? বর্তমানে উন্নয়নের যেসব তত্ত্ব ও মডেল প্রচলিত আছে, সেগুলো সবই উন্নত দেশগুলোয় সৃষ্ট। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশ সেসবের ভিত্তিতে নিজস্ব উন্নয়ন ও সংস্কার নীতিমালা গ্রহণ করেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকাংশই উন্নত বিশ্বের মডেল অনুসরণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

উল্টো কোনো কোনো দেশের সমস্যা বেড়েছে। দৃশ্যত, তাদের সকল নীতি উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকেই বেশি পুষ্টি জুগিয়েছে। এই অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘চীনা মডেল’ হতে পারে পরীক্ষিত বিকল্প।

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ৩০ বছর ধরে চীন অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ কর্তৃক গৃহীত উন্নয়নের পথই মূলত অনুসরণ করে আসছিল। কিন্তু সেই পথ চীনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। অথচ সংস্কার ও উন্মুককরণের নীতি তথা সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি গ্রহণের পর, চল্লিশ বছরে চীন অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করে। ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বেশি উন্নয়ন অর্জনের উদাহরণ আর নেই। এই উন্নয়নকে আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না; চীনের অর্জনকে ব্যাখ্যা করতে এখন নতুন তত্ত্ব প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলেই মনে হচ্ছে।

চীন বড় দেশ। এটি এখনো উন্নয়নশীলই রয়ে গেছে। ফলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে চীনের মিলমিশ এখনো স্পষ্ট। এই অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নয়নের ‘চীনা মডেল’ বা ‘চীনা তত্ত্ব’ ব্যবহার করতে পারে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নয়নের ‘চীনা মডেল’, উন্নত বিশ্বে সৃষ্ট মডেল বা তত্ত্বের চেয়ে অধিক কার্যকর প্রমাণিত হবে, এমনটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)